Film Review: ভালবাসার ওমে ফেরার গল্প বলে ‘আরো এক পৃথিবী’

Share It

অতনু রায়

সাম্প্রতিক সময়ে সমস্ত শিল্প মাধ্যমে একটা অদ্ভুত রকমের পরিবর্তন এসেছে। একটা সময় পর্যন্ত মানুষ মনে করেছে একজন শিল্পী ব্যক্তি জীবনে চরম অগোছালো হতে পারেন কিন্তু অন্যদের থেকে কোনো একটা কাজ তিনি অনেক গুছিয়ে করতে পারেন বলেই সেটা শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয়। সময় বদলেছে, শিল্পভাবনা বদলেছে, শিল্পীর ভাবনাও বদলেছে। এই বদলে যাওয়া শিল্পভাবনার এক নির্বিকার অভিযাত্রিক অতনু ঘোষ। এর আগের ন’টা ছবি যে অতনু বিশেষ কোনো ফর্মুলা মেনে বানিয়েছেন, তেমনটা যেমন নয় আবার বাংলা ছবির তথাকথিত সব ছককে ভেঙেছেন সেটাও নয়।

নিজের দশ নম্বর ছবিতে এসে অতনু যে অনেক পরিণত, এ কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না কারণ যে কোনো শিল্পী তাঁর প্রত্যেক কাজের সাথে সাথে পরিণত হন এবং স্বাভাবিকভাবেই অতনু নিজের পরের ছবিতে আরও পরিণত হবেন। এই ছবিতে একটা জায়গায় গড়পড়তা ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে বসলেন তিনি। যে বিক্ষিপ্ততার প্রতি সাধারণত উদাসীন থেকেছে বাঙালি দর্শক সেই দর্শককেই অতনু উপহার দিলেন নিজের বিক্ষিপ্ত ভাবনার এক আখ্যান। আর এই জায়গা থেকেই ‘আরো এক পৃথিবী’ একদম আলাদা। ভাল গল্পবলিয়ের তকমা ঝেড়ে না ফেলে আমাদের পাশে থাকা অনেক মানুষ যারা আমাদের সমাজের অংশ হয়েও অংশ নয় তাদের কথাই গল্পে বুনলেন পরিচালক অতনু ঘোষ।

চারজন মানুষের জীবন বিক্ষিপ্তভাবে গড়াতে গড়াতে একটা জায়গায় এসে মিলল কালের নিয়মে। চারটে চরিত্র একেবারে চারটে ভিন্ন আর্থসামাজিক অবস্থাকে তুলে ধরেছে তাদের যাপনের মধ্যে দিয়ে। প্রতীক্ষা (তাসনিয়া ফারিণ), অরিত্র (সাহেব ভট্টাচার্য), আয়েশা (অনিন্দিতা বসু) এবং শ্রীকান্ত (কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়), এই চারটে চরিত্রের একটাই মিল যে তাঁরা প্রত্যেকেই শিক্ষিত। প্রতিটা চরিত্রের আলাদা স্ট্রাগল নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি গঠনগত আর যাপনগতভাবেও একেবারেই আলাদা চরিত্রগুলোকে কিভাবে মেলালেন পরিচালক সেটা জানতে হলে অবশ্যই দেখতে হবে ছবিটা।

গল্পের টাইমফ্রেম ২০০৭ থেকে ২০২২। এই ১৫ বছরের মধ্যেই রয়েছে দীর্ঘ অতিমারি। ছবির বেশিরভাগ অংশের শুটিং হয়েছে লন্ডনে। কিন্তু তথাকথিত বিদেশি লোকেশন যেরকম ভাবে আমরা দেখে অভ্যস্ত এতে তা নেই। লন্ডন বা প্রবাস আসলে এই ছবির ‘পঞ্চম’ মুখ্য চরিত্র।

‘প্রতীক্ষা’র প্রতীক্ষা দিয়েই শুরু হয় এই ছবির স্বপ্নের বুনন। আর তারপরে দু’ঘন্টায় বাস্তব আর স্বপ্ন মিলেমিশে একাকার হয়ে ছবির গানের মতই প্রশ্ন তুলে যায় ‘স্বপ্ন দেখছো তুমি, নাকি স্বপ্নেরা দেখে তোমায়?’

এই ছবি মূলত ভাবনা নির্ভর যার একটা বড় অংশ জুড়ে আছে সংলাপ কিন্তু কোনোভাবেই সংলাপের ভারে জর্জরিত নয়। বরং কিছু জায়গায় খুব সাধারণ সংলাপের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার আছে বলতেই হয়।

আপ্পু প্রভাকর-এর চিত্রগ্রহণ বেশ ভাল। ছবিতে কালার টোনের ব্যবহারও খুব সুন্দর। সুজয় দত্ত রায়-এর সম্পাদনা এই ছবিকে নির্মেদ রাখতে সাহায্য করেছে। এই ছবির সুরারোপ করাও একটু কঠিন ছিল আর সেটা খুব গুছিয়ে করেছেন দেবজ্যোতি মিশ্র। ছবিতে গানের প্রাচুর্য নেই কিন্তু গানগুলো আসলে এই ছবির প্রশ্নগুলোকে তুলে দিয়ে গেছে। আর প্রশ্নের সঙ্গে ছবির মেজাজ সাজুয্যপূর্ণ করে তোলার ক্ষেত্রে সুরকারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শ্রীকান্তর চরিত্রের বেহালা বাজানোর ব্যাপারের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন দেবজ্যোতি মিশ্র। এই ছবির মিউজিক বেশ আলাদা যা যেন ক্লাইম্যাক্সে গিয়ে পূর্ণতা পায়। ছবির সাথে সাথে মিউজিকও আলাদা করে পূর্ণতা পাওয়ার এই ফিলটা তৈরি করেছেন দেবজ্যোতি এই ছবিতে।

অভিনয় এই ছবির অন্যতম সম্পদ। অরিত্র চরিত্রে সাহেব ভট্টাচার্য বেশ ভাল। অভিনেতা হিসেবে সাহেব যথেষ্ট পরিণত হলেও খুব একটা সিরিয়াস চরিত্রে তাঁকে ভাবা হয় না দুর্ভাগ্যজনক ভাবে। ‘অরিত্র’ অন্য ধারার ছবিতে সাহেবের জায়গা পোক্ত করবে আশা করা যায়। চরিত্রের ক্রাইসিস আর ভালনারেবলিটি খুব ভাল ফুটিয়ে তুলেছে সাহেব।

আয়েশা হয়ে উঠেছেন অনিন্দিতা বসু। অনিন্দিতার স্মার্ট লুক আর যাপন হয়ে উঠেছে আয়েশার পরিপূরক। তাই অনিন্দিতাকে কিছুক্ষণ পর থেকেই আয়েশা ভেবে নিতে দর্শকের কোনও অসুবিধা হবেনা। খুবই সহজাতভাবে চরিত্রটাকে ফুটিয়ে তুলেছে অনিন্দিতা এবং যথেষ্ট এক্সপ্রেশিভ ও, বলাই বাহুল্য।

কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় তাঁরই মতো। পরপর একের পর এক ছবিতে কৌশিকের অভিনয় মুগ্ধ করছে দর্শকদের। এই ছবিও তার ব্যতিক্রম নয়। এই ছবি দেখলে বোঝা যাবে যে শ্রীকান্ত আসলে কৌশিকের জন্যই তৈরি একটা চরিত্র। তাঁকে না পেলে শ্রীকান্ত চরিত্রটাকে নতুন করে লেখার দরকার হত পরিচালকের।

শেষে বলব এই ছবির নবাগতা শিল্পীর কথা। তাসনিয়া ফারিণ। বাংলাদেশের সুপরিচিত অভিনেত্রী তাঁর জীবনের প্রথম ছবি করলেন এবং সেটা কলকাতায়। আশ্চর্যভাবে প্রতীক্ষা’র সঙ্গে তাসনিয়া এমন মিলেমিশে গেলেন যে ছবি দেখে বেরোনোর সময় প্রতীক্ষা-ই মনে থেকে গেল। এরপরে তাসনিয়া যতদিন অভিনয় করবেন, প্রতীক্ষা’কে বয়ে বেড়াতে হবে তাঁকে। নিজের প্রথম ছবিতেই পারফরম্যান্সকে যে উচ্চতায় পৌঁছে দিলেন অভিনেত্রী তাতে পরবর্তীতে তাঁর চাপ বাড়বে। এই ছবিতে তাসনিয়ার চরিত্রে অন্যরকমের শেড রয়েছে তাই আপাতদৃষ্টিতে খুব সরল মনে হলেও এই চরিত্রে অভিনয় করাটা সরল ছিল না। অতনু ঘোষের মুন্সিয়ানার পরিচয় যে তিনি তাসনিয়াকে অপূর্বভাবে ব্যবহার করেছেন। এক্সপ্রেশনের দিক থেকে তাঁকে যথাযথ বললেও কম বলা হয়। বলতেই হয়, নিজের অভিষেকটাকে স্মরণীয় করে রাখলেন তাসনিয়া ফারিণ।

সৌমিত্র চক্রবর্তীও এই ছবিতে চমৎকার। প্রতীক্ষার নৈহাটিতে বাস করা বাবার চরিত্রকে সহজভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সৌমিত্র। চিত্রনাট্যে তাঁর জন্য থাকা সুযোগের বিন্দুমাত্র অপব্যবহার করেননি তিনি।

এই ছবি আসলে ফেরার কথা বলে। সেটা হতে পারে শিকড়ের কাছে, হতে পারে ভালবাসায়, হতে পারে বিশ্বাসে আবার হতে পারে ভরসায়। কিন্তু ফেরাটা থাকে। ছবির সংলাপেই উঠে এসেছে আর্নস্ট হেমিংওয়ে’র ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’র বিখ্যাত উক্তি “এ ম্যান ক্যান বি ডেস্ট্রয়েড বাট নট্ ডিফিটেড”।

শেষে অবশ্যই বলব, দশ নম্বর ছবির অতনু যেন ১০ নম্বর জার্সি পড়া সেই প্লে-মেকার যিনি মাঝমাঠ থেকে একটি বল তৈরি করে গোল মুখে সাজিয়ে দিচ্ছেন সতীর্থদের জন্য যেখান থেকে গোল না হওয়াটাই সব থেকে আশ্চর্যের।

অবশ্যই দেখুন ‘আরো এক পৃথিবী‘। অনুভব করুন চারপাশে আমরা যা দেখি সেটা কি তাইই? প্রত্যেক হাসির পেছনে সত্যিই কি রয়েছে অপার সুখ? নাকি ‘যতটা জীবন দুটো হাতে ধরে, তার চেয়েও বেশি বয়ে নিয়ে চলা’।

Loading


Share It