Film Review: ‘অপরাজিত’ বাঙালির নস্টালজিয়ার দুঃখবিলাসে প্রকাশ্যে চোখ মোছার অহংকার
অতনু রায়
অনেকদিন আগে জন লি হ্যানকক-এর ‘সেভিং মিঃ ব্যাঙ্কস্’ ছবিটা দেখেছিলাম। দেখেছিলাম কিভাবে রবার্ট স্টিভেনসনের ‘মেরী পপিনস্’ ছবি বানানোর নেপথ্যের গল্প দেখিয়ে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছিলেন হ্যানকক-এর দুই তুরুপের তাস এমা থমসন আর ওয়াল্টার ডিজনি’র ভূমিকায় অভিনয় করা টম হ্যাঙ্কস্। সেই ছবি ভাললাগার একটা রেশ থেকে গেছে তাই শুরুতেই হয়ত লিখলাম এই কথা। ঠিক এভাবেই আজ থেকে অনেক বছর পরে কোনও একজন চলচ্চিত্র সমালোচক যদি তাঁর লেখা শুরু করেন এই ছবির কথা দিয়ে, অবাক হব না। হ্যাঁ, ভারতীয় ছবির ইতিহাসে একটা স্থায়ী জায়গা নিয়ে থেকে যাবার মত একটা ছবি বানিয়েছেন পরিচালক অনীক দত্ত। ভাল ছবি যেমন কখনোই ভাষার বেড়াজাল মানে নি, এই ছবিও সেই পথেই চলেছে। তাই অনীক দত্ত’র ‘অপরাজিত’ যতটা বাংলা ছবি ঠিক ততটাই আন্তর্জাতিক ছবি। সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষে এর থেকে ভাল শ্রদ্ধার্ঘ্য সম্ভব ছিল কিনা তা তর্কসাপেক্ষ তবে তর্কাতীতভাবে এই ছবি অনীকের চলচ্চিত্রপঞ্জীর মধ্যে সেরা।
সত্যজিৎ রায়ের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। অনেক ভাবেই হতে পারত এই শ্রদ্ধার নিবেদন। পরিচালক অনীক দত্ত বেছে নিয়েছেন সত্যজিতের প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী’ তৈরির নেপথ্যের কাহিনী। এটা এমন একটা পথ, যে পথ একইসঙ্গে সোজা আবার কঠিন। সোজা এই জায়গায় যে, সাধারণ দর্শকের কাছে সত্যজিতের স্ট্রাগলের কোনও প্রামাণ্য রেফারেন্স নেই। আর কঠিন এই কারণে যে, সত্যজিৎ রায় নামের মহীরুহ কেমনভাবে কথা বলতেন, কেমন করে হাঁটতেন, কেমন করে অ্যাকশন-কাট্ বলতেন বা কেমন ভাবে ফিরে তাকাতেন সেই সমস্ত খুঁটিনাটি মানুষ মনে গেঁথে রেখেছেন ইন্টারনেটের কল্যাণে।
এই সব পরিস্থিতিতে পরিচালককে পরীক্ষা দিতে হয় চরিত্রায়ণের ক্ষেত্রে। অনীক সেই পরীক্ষা দিয়েছেন অভিনেতা জীতু কামাল-কে সত্যজিৎ রায়ের ভূমিকায় ‘কাস্ট’ করে। এসব পরীক্ষায় তখনই জেতা যায় যখন সেই অভিনেতাও ভেতর থেকে লড়াইটাকে নিজের লড়াই ভাবেন। জীতু শুধুমাত্র এই পরীক্ষায় অনীককে উতরে দিয়েছেন বললে অপরাধ হবে, বরং অনীকের হাত থেকে দৌড়ের ব্যাটনটা নিয়ে আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠেছেন ‘অপরাজিত’।

সারা পৃথিবীর মননশীল ছবির ভিড়ে দিন কাটাতে কাটাতে সেখান থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে গিয়ে নিজস্ব একটা চিত্রভাষার জন্ম দেওয়া মুখের কথা নয়। ১৯৪৭-এ ‘কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি’ মুভমেন্ট থেকে শুরু করে ‘পথের পাঁচালী’ তৈরি, সত্যজিতের পার হওয়া রাস্তা ছিল অনেকটা রোটাং পাসের রাস্তার মত। সেই বিষয়টাকে আজকের সব-পেয়েছির যুগে বিশ্বাসযোগ্য করে বানানোর জন্য বিশেষ সাধুবাদ প্রাপ্য পরিচালকের। এক্ষেত্রে বলাই বাহুল্য, সাদা-কালোতে ছবিটা বানানো একটা মাস্টারস্ট্রোক। সাদা-কালোতে জীতু একবারও বুঝতে দিলেন না পর্দায় দর্শক সত্যজিতকে দেখছেন না। সাম্প্রতিক অতীতে ভারতীয় ছবি দেখতে গিয়ে এই অনুভূতি একমাত্র হয়েছে ‘৮৩’ ছবিতে। যেখানে পর্দা জুড়ে কপিল দেবকে দেখেছি, একবারও রণবীর সিংকে নয়। নিজের আগের দু-একটি ছবির অভিনয়কে সম্পূর্ণ অন্য দিকে সরিয়ে রেখে নিজের অভিনয়কে যে উচ্চতায় নিয়ে গেলেন জীতু সেটা সাম্প্রতিক অতীতে ভারতীয় ছবিতে বিরল বললে অত্যুক্তি হবেনা। আগামী বছরের সমস্ত পুরস্কারের মঞ্চে বারবার তাঁকে দেখা গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
আরও পড়ুন: ভালবাসার ওমে ফেরার গল্প বলে ‘আরো এক পৃথিবী’
পরিচালক অনীক আমাকেই এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘পথের পাঁচালী’ আসলে বিদেশি ছবির ওয়্যারহাউসে মজে যাওয়া সত্যজিতের নিজের ঘরে ফেরা। অনীকের ক্ষেত্রে একটু অন্যভাবে বলা যায়, প্রথম ছবি ‘ভুতের ভবিষ্যত’-এর পরে গত ছবি ‘বরুণবাবুর বন্ধু’তে ঘরের দিকে পা বাড়ালেও ‘অপরাজিত’ তাঁর পুরোপুরি ভাল ছবিতে ফেরা। প্রথম ছবিতে ছন্দে ছন্দে সংলাপ লিখেছিলেন, এই ছবিতে লিখলেন এক আস্ত কবিতা যা ছুঁয়ে যাবেই সিনেমাপ্রেমীদের। এই ছবি বাঙালিকে বাধ্য করবে আরেকবার ‘পথের পাঁচালী’ দেখতে। এই ছবি আবার একবার বাধ্য করবে সর্বজয়ার সহমর্মী হয়ে চোখের জল ফেলতে। অনেক নস্টালজিয়ার একটা দুঃখবিলাস থাকে। ‘অপরাজিত’ সেই দুঃখবিলাসে প্রকাশ্যে চোখ মোছার অহংকার।

জীতুর অনবদ্য অভিনয়ের কথা বারবার লিখলেও, নাম ভূমিকার অপরাজিত অসম্পূর্ণ আরও দুজন মানুষ ছাড়া। একজন হলেন চন্দ্রাশীষ রায়, যিনি এ ছবিতে জীতুর চরিত্রের কন্ঠাভিনেতা। তাঁর কন্ঠ কখন যে জীতুর সঙ্গে মিলেমিশে সত্যজিতের হয়ে উঠেছে তা বুঝতেই পারা যায়না। ছবির ‘এন্ড ক্রেডিট’ না দেখলে অনেকে বুঝবেন না হলফ করেই বলা যায়। এক্ষেত্রে আর একটা কথা বলতেই হবে, তা হল অনীকের চন্দ্রাশীষকে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত। যেহেতু চন্দ্রাশীষের কন্ঠ চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষের কাছে একেবারেই পরিচিত নয় তাই ছবি দেখার অভিজ্ঞতায় অনাবশ্যক ‘জার্ক’ আসেনা। কোনও পরিচিত কন্ঠের ব্যবহার এই ‘জার্ক’টাই বয়ে আনত।
দ্বিতীয়জন হলেন মেক-আপ আর্টিস্ট সোমনাথ কুণ্ডু। মেঘনাদের মত অন্তরালে থেকে যে যুদ্ধ সোমনাথ করেছেন তা তৈরি করে দিয়েছিল অপরাজিত থাকার নান্দীমুখ। যেভাবে একের পর এক ছবিতে মেক-আপ বিষয়টাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন সোমনাথ তাতে অন্যান্য ভাষার ছবির জগৎ তাঁকে নিয়ে ভাবতে শুরু করতেই পারেন।
বিজয়া রায়ের (ছবিতে বিমলা) চরিত্রে সায়নী ঘোষ যথাযথ, যদিও সঙ্গত করা ছাড়া কিছুই করার ছিলনা তাঁর। সত্যজিতের মা সুপ্রভা রায়ের (ছবিতে সুরমা) চরিত্রে অনসূয়া মজুমদার, সর্বজয়ার (ছবিতে সর্বমঙ্গলা) চরিত্রে অঞ্জনা বসু, অপুর (ছবিতে মানিক) চরিত্রে আয়ুষ মুখোপাধ্যায়, দুর্গার (ছবিতে উমা) চরিত্রে অনুষা বিশ্বনাথন চরিত্রের সঙ্গে মানানসই।
এই ছবিতে সম্পাদনা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার ছিল এবং অর্ঘ্যকমল মিত্র পাশ করেছেন লেটার মার্কস নিয়ে। ক্যামেরায় সুপ্রতিম ভোল স্বকীয়তার ছাপ রেখেও ধরে রেখেছেন ‘পথের পাঁচালী’র রেশ। সাদা-কালো ছবিতে আলোর ব্যবহার এত চমৎকার যে আলাদা করে চোখে পড়ে। যাঁরা ‘পথের পাঁচালী’ দেখেছেন তাঁরা বুঝতে পারবেন যে অনেক খুঁটিনাটি বিষয় নজর দিয়ে যথেষ্ট যত্ন সহকারে পরিচালক এই ছবি বানিয়েছেন।

‘পথের পাঁচালী’র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হল ছবির সঙ্গীতায়োজন। কিংবদন্তি পন্ডিত রবিশঙ্কর-এর সঙ্গীতকে আপাদমস্তক ছুঁয়ে থেকেও না ছোঁয়া খুব সোজা কাজ ছিল না। সেই কাজটাই অবলীলায় করেছেন দেবজ্যোতি মিশ্র। ২ ঘন্টা ১৮ মিনিটের ছবি জুড়ে চিত্রনাট্যের।চলনের সঙ্গে পরিপূরক হয়ে বেজেছে দেবজ্যোতির সঙ্গীত যা প্রশংসার দাবি রাখে।
এরকম একটা ছবির মাধ্যমে বিশ্ববন্দিত সত্যজিৎ রায়কে শ্রদ্ধার্ঘ্য দেবার জন্য প্রযোজক ফিরদাউসুল হাসানের আলাদা ধন্যবাদ প্রাপ্য। বাংলা ছবিকে পরপর ভাল ছবি উপহার দিয়ে হাসান সমৃদ্ধ করছেন ভারতীয় ছবির ঐতিহ্যকে।
সবশেষে বলব, একেকটা সময় আসে যখন দর্শককে পরীক্ষা দিতে হয়। অনীক দত্ত পরিচালক হিসেবে এই ছবি বানিয়ে সবথেকে বড় পরীক্ষার মুখে ফেলে দিয়েছেন দর্শককে। এবার দর্শককেই প্রমাণ করতে হবে নন্দন বোধের উদযাপনে তাঁরা ‘অপরাজিত’ নাকি মধ্যমেধার মননের ভিড়ে ‘ব্যর্থ’।