Film Review: ‘অরণ্য’র প্রাচীন প্রবাদ’ নবীন পরিচালকের কপিবুক স্ট্রেট ড্রাইভ

Share It

অতনু রায়

‘অরণ্য’র প্রাচীন প্রবাদ’ ক্রীড়া সাংবাদিক দুলাল দে’র প্রথম পরিচালনা। তবে নিজের প্রথম ছবিতে তিনি বেছেছেন অন্য ধারার গল্প, শুধু কেক-এর উপরের টপিংয়ের মত করে ছড়িয়ে দিয়েছেন খেলাকে। কখনও সংলাপে, কখনও কানেক্টর হিসেবে। চিত্রনাট্যের ব্যালান্স খুব সুন্দর বজায় রেখেছেন দুলাল। তিনি একটা নতুন ধরণের গোয়েন্দা গল্প উপস্থাপন করলেন কিন্তু একদম হালকা ভাবে ক্রিকেটটা রেখে দিলেন। ‘অরণ্য’র প্রাচীন প্রবাদ’ আসলে নবীন পরিচালকের কপিবুক স্ট্রেট ড্রাইভ। এবারে সবকিছুই কি সিনেমার নিরিখে সফল হল?

১২৩ মিনিটের এই ছবির গল্প বিশেষ কোনও একটা চরিত্রকে ঘিরে আবর্তিত হয় না বরং বেশ কয়েকটা চরিত্র আর একটা বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হয়। চিত্রনাট্য পরিচালক নিজেই লিখেছেন এবং বলতেই হয় যে প্রত্যেকটা চরিত্রকে প্রয়োজনীয় স্পেস দিয়েছেন তিনি। চিত্রনাট্যের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন কোপা আমেরিকা আর ইউরো কাপের সময়। তো বলাই যায়, টিত্রনাট্যের কল্যাণে প্রথম নকআউট ম্যাচ জিতে কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছেছেন দুলাল। তবে ‘ক্লিন শিট’ রাখতে পারলেন কি? সেই উত্তর খুঁজে নিই একটু। সেক্ষেত্রে বলব গোল করে, আত্মঘাতী গোল খেয়ে ড্র হতে চলা একটা ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ের একদম শেষ মিনিটে চমৎকার একটা বাইসাইকেল কিকে গোল করে কোয়ার্টার ফাইনালে এসেছেন নতুন পরিচালক।

মাইক ব্রিয়ায়লি এবং সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের নামকে খুব সুন্দর ভাবে ব্যবহার করেছেন চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে। একদিকে ক্রিকেটার আরেকদিকে সাইকো-অ্যানালিস্ট ব্রিয়ারলি দারুণ ব্যক্তিগত পরিসংখ্যান ছাড়াও কেন বড় ক্যাপ্টেন সেটা তাত্ত্বিক কচকচিতে না গিয়েও বুঝিয়েছেন।

অরণ্য চট্টোপাধ্যায় (জীতু কমল) ডাক্তারি পড়ে আবার সিএবি টুর্নামেন্টে ক্রিকেটও খেলে। অরণ্য’র জামাইবাবু সুদর্শন হালদার (শিলাজিৎ) সিআইডি অফিসার। জামাইবাবুর সঙ্গে খুব ভাল সম্পর্ক তার। সুদর্শনের হাতে আসে এক ডাক্তার অমিত রায় (সুহোত্র মুখোপাধ্যায়) খুনের অমীমাংসিত কেস আর পাকেচক্রে এই অরণ্য জড়িয়ে যায় জট ছাড়ানোর খেলায়। এবার কেসটা কে সলভ্ করে, সুদর্শন না অরণ্য সেটা জানতে তো ছবিটা দেখতে হবে। তবে আমরা যেরকম ভাবে ফেলুদা, ব্যোমকেশ, শবর, মিতিন মাসি দেখি, এখানে তার থেকে অনেকটা সরে গিয়ে একটা নতুন ধারার গোয়েন্দা গল্প বলতে চেয়েছেন দুলাল। একটা সারল্যের বুনোটে সাফল্যকে ছুঁতে চাওয়া বলা চলে। রাজনৈতিক প্রভাব আর সামাজিক বাস্তবতাকে একটা সরল গল্পের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরলেন গল্পকার-পরিচালক।

ছবির অরণ্য আর পাঁচজন গোয়েন্দার মত সবকিছুকে ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে না। বরং অনেক সময়েই ঢাকা পড়ে যায়। সে ভুল করে, প্রেমিকার ধ্যাতানি খায়, হতাশ হয়, নিজের হার মেনে নেয় নিজের মুখে, ঠিক আমার আপনার পাশের বাড়ির ছেলেটার মত। সে ঠিক তথাকথিত নায়কোচিত নয়, অনেক বেশি মাটির কাছের। আর এই জায়গাতেই অরণ্যকে জিতিয়ে দিয়েছেন জীতু। ‘এফর্টলেস’ অরণ্য হতে যা যা দরকার সব করেছেন জীতু। চরিত্রের সারল্য আবার স্মার্টনেস দুটোকেই খুব সুন্দর করে ক্যারি করেছেন তিনি।

আরও পড়ুন: সাগরপাড়ে শুরু, বাংলায় এবার সাতদিন ‘ফ্রাইডে’!

আরও পড়ুন: ‘অপরাজিত’ বাঙালির নস্টালজিয়ার দুঃখবিলাসে প্রকাশ্যে চোখ মোছার অহংকার

খুন হয়ে যাওয়া ডাক্তার অমিত রায়ের স্ত্রী দেবযানীর চরিত্রে রাফিয়ত রশিদ মিথিলা বেশ ভাল। এই ছবিতে দেবযানীর চরিত্রে অনেকগুলো পরত রেখেছেন দুলাল এবং মিথিলা সেই প্রত্যেকটা পরত বিশ্বাসযোগ্য করেছেন মুন্সিয়ানার সাথে। তবে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ক্লোজ শটে মিথিলার মেকআপ বড্ড চড়া মনে হয়েছে। চরিত্রের জন্য ওই মেকআপের প্রয়োজন ছিল না। ওটা ছাড়াই ওঁকে পর্দায় আরও সুন্দর লাগত।

শিলাজিৎ এই ছবিতে শান্ত অথচ তীক্ষ্ণ। ক্রিকেটীয় ভাষায় ধরে খেলে শুধু স্ট্রাইক রোটেট করে গেছেন তিনি। নিজের অভিনয়ের পরিমিতিবোধের প্রমাণ শিলাজিতের সুদর্শন।

আর এই ছবির প্রাণ অমিত রায়ের ভূমিকায় সুহোত্র মুখোপাধ্যায়ের অনবদ্য অভিনয়। অভিনয়ে নির্মেদ সুহোত্র। কোনও ‘অতি’ নেই। চরিত্রের মূল্যবোধ, পাওয়া, না পাওয়া, গৌরব, ব্যর্থতা তিনি এত সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন পর্দায় যে শুধু ওঁর জন্যই ছবিটা একবার দেখে ফেলা যায়। ছবিতে অমিত এবং দেবযানীর ভালবাসার অ্যাঙ্গেলটাকে খুব সুন্দরভাবে এক্সপ্লোরও করেছেন পরিচালক।

স্থানীয় থানার পুলিশের বড়বাবুর চরিত্রে নজর কেড়েছেন বাস্তবের পুলিশ অলোক সান্যাল। স্থানীয় থানার পুলিশ এবং সুদর্শনের সহকারী সন্দীপের ভূমিকায় সায়ন ঘোষ কমিক রিলিফ। স্থানীয় হাসপাতালের সুপারের ভূমিকায় দারুণ অভিনয় করেছেন লোকনাথ দে। তিনি চরিত্রটাকে একটা অন্য উচ্চতায় তুলে নিয়ে গেছেন। এই ছবিতে আলাদা করে নজর কাড়বেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। স্থানীয় বিধায়ক নীহার মন্ডলের চরিত্রে তিনি অনবদ্য অভিনয় করেছেন। চরিত্রটা অন্য এক মাত্রা পেয়েছে বুদ্ধস্পর্শে। পার্শ্ব চরিত্রের বাকি অভিনেতারা বেশিরভাগই হতাশ করেছেন।

আরও পড়ুন: অনির্বাণের নিবেদনে আসছে ‘মানিকবাবুর মেঘ’

আরও পড়ুন: ‘ছবি দেখানোর খরচ কমল, দেখার খরচে খিঁচ’, কী বলছে ইন্ডাস্ট্রি?

এই ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বেশ অন্যরকম লেগেছে। শুভদীপ গুহ ভাল কাজ করেছেন। প্রতীপ মুখোপাধ্যায়ের ক্যামেরাও বেশ ভাল ভাবে ঘুরে বেড়িয়েছে গ্রাম থেকে শহরে, চরিত্রের মেজাজ ধরে।

কিছু জায়গায় মিসফায়ারও করেছেন নতুন পরিচালক। যেমন, সন্দীপকে ছোট করে স্যান্ডি বলার পাশাপাশি কারও নাম গগনদীপ হলে ছোট করে গান্ডু বলা হত ধরণের সংলাপ ভীষণ আনস্মার্ট। চিত্রনাট্যকে আরও টানটান করতে এই ধরনের জোর করে কিছু সংলাপ ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রবণতা ছাড়তে হবে। আবার ছবির শেষের দিকে অরণ্যর গাড়ির ড্রাইভারকে “শিলাজিৎ দার গান চালাও তো” বলা প্লেয়িং টু দ্য গ্যালারি হলেও ছবির মেজাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় হাততালি আসে না। বারবার একটা বিশেষ কাগজকে তুলে দেখানো এবং গ্রামের স্টলেও নাম করে সেই কাগজ খুঁজতে যাওয়াটা বড় বোকা বোকা লেগেছে। পরিচালক সত্ত্বার জন্য নিজের সাংবাদিকতার খোলস থেকে একেবারে বেরিয়ে আসতে হবে দুলালকে। এই ছবির সর্বাত্মক ব্র্যান্ড প্লেসমেন্ট সিংহভাগ ক্ষেত্রেই আরোপিত লেগেছে এবং গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ছবিকে ক্ষতিগ্রস্তও করেছে। আশা করব, পরিচালক পরের ছবিতে এটা মাথায় রাখবেন। সর্বোপরি ছবির প্রায় শেষের দিকে যেভাবে একটা বিজ্ঞাপনকে মোবাইলে চালিয়ে সেটাকে সূত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হয়েছে সেটা একদম ছবির চলনের বিপরীতে গেছে। যে সময় বিজ্ঞাপন না দেখার জন্য মানুষ অতিরিক্ত খরচা করতে রাজি থাকে সেই সময়ে কেউ মোবাইলে কেবল বিজ্ঞাপনটাই দেখছে!

শিলাজিতের চরিত্রের মুখে থাকা একটা সংলাপ “গোয়েন্দাকাহিনি পড়া আর গোয়েন্দাগিরি দুটোর মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে” এই ছবির সার। আর ঠিক এই পার্থক্যটাই দুলাল তাঁর প্রথম ছবিতে ফুটিয়ে তুলেছেন যত্ন করে। এইটা মাথায় রেখে দেখলে অরণ্যকে ঠিক ভালবেসে ফেলবেন। আর ছবির শেষে একটা নয়, ডবল টুইস্ট আছে। এই ডবল টুইস্টই হল অতিরিক্ত সময়ের একদম শেষ মিনিটের সেই গোল যেটা করে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে এসেছেন দুলাল।

এবারে অরণ্য গোয়েন্দা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবেন নাকি ক্রিকেটার নাকি ডাক্তার নাকি ব্রিয়ারলির মত দুটো সেটা নির্ভর করছে গল্পকারের উপর। ছবি দেখে মনে হয়েছে, অরণ্য এর পরে কী করে সেটা দর্শকরা জানতে চাইবেন। তাহলে কি কোনও ফ্রাঞ্চাইজির সম্ভাবনা খুলে রেখেছেন গল্পকার-পরিচালক? ‘অরণ্য’র প্রাচীন প্রবাদ’-এ প্রবাদের ভূমিকাটাই বা কী? এই সমস্ত উত্তর পেতে হলে বড়পর্দায় দেখতে হবে ছবিটা। কারণ, অরণ্য আবার আসবে কিনা এটা ঠিক করবেন আপনারাই।

Loading


Share It

2 thoughts on “Film Review: ‘অরণ্য’র প্রাচীন প্রবাদ’ নবীন পরিচালকের কপিবুক স্ট্রেট ড্রাইভ

Comments are closed.