Exclusive: বাংলা ছবিতে এই রকমের পারফরম্যান্স সচরাচর আমরা দেখি না

Share It

অতনু ঘোষ

আমি দু’বছর আগে ‘মানিকবাবুর মেঘ’ ছবিটা দেখেছি। এই ছবিতে মূল চরিত্রে চন্দন সেনের পারফরম্যান্স নিয়ে আলাদা করে কথা বলা খুব জরুরি বলে আমার মনে হয়।

আমার মনে হয়, নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের কাছে এটা একটা উদাহরণ এবং অবশ্যই অনুপ্রেরণার বিষয়। চরিত্রটার পরিসর যে খুব বড় তা নয়। তাতেও কত রকমের অনুভূতি, আবেগের স্তর প্রকাশ! আর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ, সেই প্রকাশ কিন্তু কোনভাবেই সিনেমার অভিনয়ের গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে না! বেশিরভাগ জায়গায় কথা নেই, কেবল অভিব্যক্তি। কিন্তু সেই অভিব্যক্তি গুলোর মধ্যে এমন একটা প্রাণ আছে যা কখনও চরিত্রটাকে একঘেয়ে লাগতে দেয় না। এমন একটা জীবন এই ছবিতে দেখানো হয়েছে যা বাংলা ছবিতে বড় একটা দেখা যায় না। একটা গভীর একাকীত্ব, সেখান থেকে মেঘের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গল্পটাকে যে একটা পরাবাস্তবতার পর্যায় নিয়ে যাচ্ছে, যা যথেষ্ট ব্যতিক্রমী প্রয়াস বলতেই হবে।

চন্দনদার অভিনয় এমনই বিশ্বাসযোগ্য যে সেটাকে একজন সংবেদী, অভিজ্ঞ শিল্পীর জীবনদর্শন হিসেবে দেখা যেতেই পারে। বরং আমি খুব জোর দিয়ে বলতে পারি যাঁরা সিনেমার অভিনয় নিয়ে আগ্রহী তাঁদের কাছে ভীষণ আধুনিক একটা সিনেমার অভিনয়ের নিদর্শন হয়ে থাকবে। যেখানে থিয়েটারের কোনও প্রভাব নেই বা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার ব্যাপার নেই। ভীষণ সূক্ষ্ম, অন্তর্মুখী কিন্তু অনেক রকমের ছোট ছোট বদল এনেছেন চরিত্রে। চরিত্রটা তার বাবার সঙ্গে এক রকম, বাড়িওয়ালার সঙ্গে এক রকম আবার বন্ধুর সঙ্গে আরেক রকম! এমনকি গাছের সঙ্গে তার এক রকমের অনুভূতির প্রকাশ আবার যখন সে মেঘকে দেখে কোট পরে মাঠে শুয়ে পড়ছে তখন আবার অন্য রকম প্রকাশ। যখন বাড়িওয়ালা এসে তাঁকে কিছু একটা জিজ্ঞাসা করছেন, সেখানে একটা অদ্ভুত হাসি! এত সুন্দর করে কয়েকটা চকিত চমক তৈরি করেছেন, প্রয়োজনে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল তৈরি করেছেন, সেটা অনবদ্য।

আরও পড়ুন: ‘মানিকবাবুর মেঘ’-এ ভালবাসার বৃষ্টি প্রসেনজিতের

এইসব অভিনয় যখনই শুধু শৈলী নির্ভর হয়ে পড়ে, হয়তো প্রচন্ড অন্তর্মুখী বা এতটাই কম অভিব্যক্তি প্রকাশ হল যাতে চরিত্রটার আলাদা করে কোনও প্রভাবই পড়ল না, এই রকম হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। সেটা কিন্তু এখানে একদম হয়নি। সিনেমার অভিনয় হচ্ছে ছোট্ট ছোট্ট আঁচড়ের মত। Less the number of strokes, more the impression- সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রায় কথাটা বলতেন। ছোট্ট একটা আঁচড়, কিন্তু পুরো একটা পেইন্টিংয়ের মত তার বিরাট একটা ইমপ্যাক্ট। চন্দনদার চোখে মায়া, শুণ্যতা যেমন স্পষ্ট, তেমনি নির্লিপ্ত আবেগ বর্জিত দুরত্বও চমৎকার ফুটে উঠেছে। সবচেয়ে বড় কথা, দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা বা playing to the audience কোথাও প্রকাশ পায় না। কোথাও জোর করে একটা মেলোড্রামা তৈরি করার চেষ্টা নেই। শুধুমাত্র অভিনয়ের দৌলতেই মানিকবাবুর চরিত্র ঘিরে একটা অদ্ভুত ঘোর তৈরি হয়। এটা কিন্তু খুব শক্ত কাজ।

মানিকবাবুর চরিত্রটা খুব ছোট একটা রেঞ্জের মধ্যে চলে। তাঁর আনন্দ, প্রেম, ভয়, মেঘটাকে দেখে আতঙ্ক, সবকিছু নিয়ে একটা অদ্ভুত যাপন তৈরি করেছেন চন্দনদা। বাংলা ছবিতেই আজকাল এই রকমের পারফরম্যান্স সচরাচর আমরা দেখি না। কারণ, এরকম একটা বহুস্তরীয় আধারই থাকে না। আধার থাকলে তবেই তো একজন অভিনেতা সেটা করতে পারেন।

আমি বরাবর দেখেছি চন্দনদা সিনেমার পর্দায় অসাধারণ। মনে আছে, ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার’ ছবিতে একজন উগ্রপন্থীর চরিত্রে চন্দনদা চমৎকার কাজ করেছিলেন। চন্দনদার মধ্যে নিজেকে সত্যের কাছাকাছি পৌঁছে দেওয়ার একটা ক্ষমতা আছে যেটা একদম ভিতর থেকে আসে।

আজকাল আমরা কিছু ছবিকে দাগিয়ে দিই ওটিটির ছবি বলে। ওটিটিতেও হয়ত একাত্ম হতে পারা যায় কারণ সেক্ষেত্রে আমি এবং আমার স্ক্রিন ছাড়া আর কেউ নেই। তবে এটা কিন্তু একটা বড় পর্দার ছবি। কারণ, যে ঘোরের কথা আমি বলছি সেটা বড় পর্দাতেই আসবে। এই ছবিতে যে জগতটা অভিনন্দন তৈরি করেছেন, সেটা যখন বড় পর্দায় ফুটে ওঠে তা অসাধারণ।

এই ছবিতে ডিজাইনের একটা বড় ভূমিকা আছে। আমার মনে আছে, কালো থেকে সাদার মধ্যে অনেকগুলো স্তর ব্যবহার করা হয়েছে। ‘ডিফারেন্ট শেডস্ অব গ্রে’ ব্যবহার করা হয়েছে। খুব সুন্দর সাউন্ড ডিজাইন হয়েছে ছবিটার। একটা দৃশ্যের কথা বলব, মানিকবাবু একটা নতুন ঘড়ি কিনেছেন। ঘড়ির একটা খুব শার্প আর হাই ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ রয়েছে যেটা তাঁর নিজের জীবনে নেই। কিন্তু সকালবেলায় সেই ঘড়ির শব্দ ওঁর জীবনে সেই শব্দ ফেরাল। একটা পুরনো পাখার ঘোরার শব্দ আছে। Typical contrast and conflict between tradition and modernity – এ ছবির আরও এক গুরুত্বপূর্ণ স্তর।

আরও পড়ুন: অনির্বাণের নিবেদনে আসছে ‘মানিকবাবুর মেঘ’

পুরো ছবিটার ভিতরে একটা নান্দনিকতা আছে। সেটা পেইন্টিংয়ের মাধ্যমে, আর্কিটেকচারের মাধ্যমে আসে। একটা সাদা দেওয়াল, তার পাশে একটু কালচে দেওয়াল। চরিত্রের সঙ্গে বদলে বদলে যাওয়া। বড় পর্দাতেই তো আমি আস্তে আস্তে স্তর গুলোর মধ্যে ডুবে যেতে পারব। পরিচালক ছবিটাকে তৈরিই করেছেন স্তর গুলোর উপর নির্ভরশীল হয়ে। আর এই ধরণের অভিনয়, তার spacial dynamics যতটা বড় পর্দায় খুলবে সেটা ছোট পর্দায় থোড়াই খুলবে!

ওটিটি একটা ‘অল্টারনেটিভ’ নিশ্চয়ই। কারণ, বাণিজ্যিক জায়গা থেকেও আমরা ওখান থেকে কিছুটা টাকা পাই। আগে আমাদের একটা আফসোস ছিল যে সিনেমাগুলো আর দেখা যায় না। আর এখন, ‘শেষ পাতা’ দেখে একজন ত্রিনিদাদ থেকে আমাকে লিখেছেন! এই সুযোগটা আমাদের ওটিটি দিয়েছে।

জীবনকে গতানুগতিক, বাঁধাধরা ছকের বাইরে গিয়ে দেখা বা ভাবাই তো একজন চলচ্চিত্রকারের কাজ। শিল্প কী করে? শিল্প তো আসলে জীবনকে চেনায়। জীবনের আরও গভীরে যাওয়ার রাস্তাটা দেখায়। জীবনকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার রাস্তাটা খুলে দেয়। অতি সরলীকরণের ফলে সিনেমা এখন একটা একমাত্রিক জায়গা নিয়েছে। মানুষকে আমরাই তো নতুন কিছু দিচ্ছি না। আমরা দিলে মানুষ সেটা নিশ্চয়ই দেখবেন। মুশকিল হয়েছে যে, এখন আমরা দর্শকদের ভীষণ নিচু চোখে দেখছি। মনে করছি, এর বেশি কিছু দিলে দর্শক বুঝবেন না। সব থেকে বড় কথা, আমাদেরকে তো বারবার দরজায় ধাক্কা দিতেই হবে! যতবার আমরা দর্শকদের উপলব্ধির গন্ডিটাকে বড় করবার চেষ্টা করব, ততই আস্তে আস্তে তাঁর বোধের জায়গা থেকে সেগুলো ভাল লাগবে।

আমাদের যেটা সমস্যা হয়, একজন অভিনেতাকে ভেবে একটা চরিত্র তৈরি করা তো আমাদের এখানে বিরলতম ঘটনা। তবু আশা করি আবার অন্য ছবিতে কেউ হয়ত চন্দনদাকে নিয়ে ভাববে! আধুনিক সিনেমার যে অভিনয় তাতে বাংলার প্রতিনিধি হিসেবে এই ছবির খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা অবদান থাকবে। এইরকম একটা ছবি হওয়া মানে সেই অভিনেতার কিন্তু একটা নতুন জীবন পাওয়া। তাই বলব সবাই বড় পর্দায় ‘মানিকবাবুর মেঘ’ দেখুন, এক অনবদ্য অভিনয়ের উদযাপন করুন।

Loading


Share It