আনন্দ: ছক ভাঙা এক কষ্টিপাথর

Share It

অতনু রায়

১৯৭৪ সাল। একটা ছবির গান তৈরির মিটিং চলছে। পরিচালক জে ওমপ্রকাশ। ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় রাজেশ খান্না-মুমতাজ। ছবির নাম ‘আপ কি কসম’। একটা গানের সিচুয়েশন, মুমতাজ ছবিতে তাঁর স্বামী রাজেশ খান্নাকে একটা গানের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেবেন যে তাঁর ঋতুস্রাব অর্থাৎ ‘পিরিয়ড’ চলার ফলে বেশি ‘ঘনিষ্ঠ’ হওয়া যাবে না। গীতিকার পড়েছেন চিন্তায়। কিছুতেই তাঁর গানের একটা লাইনও মাথায় আসছে না। পারিবারিক ছবি, বাড়ির সকলে একসঙ্গে বসে দেখবে। লতা মঙ্গেশকর গাইবেন। এমন কোনও ভাষা লেখা যাবে না যা অস্বস্তি তৈরি করতে পারে। আর মহিলাদের ঋতুস্রাব আজকেও বিষয় হিসেবে ‘ট্যাবু’, তাহলে তখন কেমন অবস্থা ছিল বোঝাই যায়। অবশেষে লেখা হল সেই গান। হিটও করল খুব। গানটা ছিল:
“পাস নহী আনা,
ভুল নহী জানা,
তুমকো সৌগন্ধ হ্যায় কে,
আজ মহব্বত বন্ধ হ্যায়”।

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে যে গীতিকার এইভাবে ভেঙে দিয়েছিলেন ‘পিরিয়ড ট্যাবু’, আজ তাঁর জন্মদিন। আনন্দ বখসি (Anand Bakhshi)। অবশ্য ওঁর কেরিয়ারের শুরুতেই এক প্রযোজক ভুল করে বখসির প্রথম ‘h’ টা উড়িয়ে দিলেন। সেই থেকে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জন্য তিনি আনন্দ বকসি (Anand Bakshi)।

যে ক’জন গীতিকার জীবনের সার সত্য সহজ ভাষায় গানে তুলে ধরতে পেরেছেন, আনন্দ তাঁদের অন্যতম। দার্শনিকের মত খুব গভীর বিষয় সোজা গানের মাধ্যমে বলেছেন। তিনিই তো ‘অমর প্রেম’ ছবিতে লিখতে পেরেছেন সেই বিখ্যাত লাইন:
“কুছ রীত জগৎ কী অ্যায়সি হ্যায়,
হর ইক শুবহ্ কী শাম হুই;
তু কৌন হ্যায়, তেরা নাম হ্যায় কেয়া?
সীতা ভী ইয়াহাঁ বদনাম হুই!
ফির কিউঁ সংসার কী বাতোঁ সে,
ভীগ গয়ে তেরে ন্যয়না?”

আরও পড়ুন: বাংলা ছবিতে এই রকমের পারফরম্যান্স সচরাচর আমরা দেখি না

শচীন দেব বর্মন নাকি তাঁকে প্রায়ই বলতেন, “বকসি, গল্পটা ঠিক করে শোনো। গল্পের মধ্যেই গান আছে”। আজীবন বহুবার গল্প শুনতেন তিনি। বারবার স্বীকার করেছেন তাঁর জীবনে সাহির লুধিয়ানভি আর শৈলেন্দ্র, এই দুজনের অবদান। দুজনেই তাঁকে আলাপ করিয়ে দিয়েছেন ইন্ডাস্ট্রির অনেক মানুষের সঙ্গে। কিন্তু সমালোচক এবং ইন্ডাস্ট্রির একটা বড় অংশ তাঁকে কখনও ‘শায়র’-এর মর্যাদা দেয়নি। আনন্দের কষ্ট হয়েছে। নিজে বারবার বলেছেন, “আমি কেবলই একজন ছবির গীতিকার। আমি জানি আমি ‘শায়র’ নই।” কথা থামেনি। কষ্ট গান হয়েছে। আমরা শুনেছি ‘ববি’ ছবিতে “ম্যায় শায়র তো নহী“। সুযোগ পেতেই আবারও লিখেছেন শক্তি সামন্ত’র ‘আজনবী’ ছবির গানের সেই বিখ্যাত লাইন গুলো:
“জানেমন, জান-এ-জিগর,
হোতা ম্যায় শায়র অগর;
লিখতা গজল,
তেরী আদাওঁ পর”।

১৯৪৬ সালের নৌ-বিদ্রোহ। আনন্দ তখন ইন্ডিয়ান আর্মির ন্যাভেল ফোর্সে। আর্মির চাকরির পাশাপাশি চেষ্টা গানের জগতকে ছুঁয়ে দেখার। প্রথমবার আর্মি ছেড়ে যখন বম্বে গেলেন, ব্যর্থতা জুটল। ব্যর্থতাকে মাথায় নিয়ে যখন ফিরে গেলেন, ভেবেছিলেন রেডিও অ্যানাউন্সারের কাজ নেবেন দিল্লি রেডিওতে। প্রত্যাখ্যাত হলেন। অবশেষে ১৯৫৬ সালে দ্বিতীয়বার বম্বে গেলেন। তখন সঙ্গে ড্রাইভিং লাইসেন্স রয়েছে। ঠিক করেই এসেছেন যে ফিল্ম কেরিয়ার যদি না তৈরি হয় তবে ট্যাক্সি চালাবেন, তবু খালি হাতে ফিরবেন না আর। ড্রাইভিং লাইসেন্সটা অবশ্য জুটে ছিল আর্মিতে ট্রেনিংয়ের সময় বড় ট্রাক চালানোর সুবাদে।

বম্বেতে এক আত্মীয় থাকতেন। ঠিক করলেন তার বাড়িতে আপাতত ক’দিন থাকতে থাকতে একটা জুতসই জায়গা খুঁজে নেবেন। তার বাড়ি পৌঁছে খাওয়া দাওয়া হচ্ছে। কথায় কথায় সেই আত্মীয় যেই বুঝলেন থাকার বিষয়, ব্যবহার বদলে গেল। হাত ধুতে গিয়ে বেসিন নোংরা করা নিয়ে কথা শোনালেন। সঙ্গে এও বলে দিলেন যে আরও একটু হাই সোসাইটির মানুষদের সঙ্গে মেলামেশা করে তার বেশ কিছু ডিসিপ্লিনে বদল আনতে হবে। আনন্দ ভেবে পেলেন না যে আর্মির জওয়ানের থেকে বেশি ডিসিপ্লিনড্ হওয়া কিভাবে সম্ভব! যাই হোক, আনন্দ বললেন যে তিনি আগে থেকে একটা ব্যবস্থা করেই এসেছেন এবং চলে এলেন।

আরও পড়ুন: অস্কার কর্তৃপক্ষ বুদ্ধদার উপরে হওয়া কাজগুলো সংরক্ষণ করতে চায়: সোহিনী

প্রথম কয়েকটা দিন দাদর রেলওয়ে স্টেশনের ওয়েটিং রুমে থাকলেন। তার কিছুদিন পরে দাদর গেস্ট হাউস এবং তারও বেশ কিছুদিন পর পশ্চিম খরের হোটেল এভারগ্রিন। তখন ওই হোটেলেই থাকতেন হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া আর তাঁর স্ত্রী অনুরাধা রায়। হোটেলে খাওয়া দাওয়ার পর সামনের একটা মিষ্টির দোকানে আড্ডা দিতেন, বসে লিখতেন। দোকানের মালিকের সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। তিনি তো রীতিমত আনন্দ-এর আর তাঁর লেখার ভক্ত হয়ে গেলেন। একদিন দোকানের মালিক আনন্দকে বললেন, আমার তোমার কবিতা গুলো খুব ভাল লাগে আর তোমাকেও ভাল লাগে। তাই তোমাকে একটা কথা বলছি, প্লিজ আর কাউকে বোলো না। আমি জানি, তুমি রাবড়ি খেতে খুব ভালবাসো। আসলে আমরা আমাদের দোকানের রাবড়িটাকে আরও গাঢ় করবার জন্য ব্লটিং পেপার দিই। আমি সত্যিই চাই না তোমার ক্ষতি হোক, তাই আমার এখানে তুমি রাবড়িটা খেও না। আসলে ওঁকে ভাল না বেসে পারা যেত না।

একবার পার্টি থেকে বাড়ি ফিরবেন। বৃষ্টি হচ্ছে, ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে তখনও আসেননি। সিগারেট ধরিয়ে জ্বলন্ত দেশলাইটা ছুঁড়ে ফেললেন রাস্তার জমে থাকা জলে। সেদিকে তাকিয়ে ভিতরে জন্ম দিলেন অবিস্মরণীয় এক গানের। সেই গান আমরা শুনলাম ‘অমর প্রেম’ ছবিতে:

“চিঙ্গারি কোই ভড়কে, তো সাবন্ উসে বুঝায়ে”।

অন্য কোনও গীতিকারের সঙ্গে এক ছবিতে গান লিখতে চাননি কখনও। তাই নিজেই বলতেন, “একটা বদগুণ রয়েছে আমার”। একবার সুযোগ এসেছিল গুরু দত্তের ছবিতে গান লেখার। ছবির নাম ‘কাগজ কে ফুল’। কিন্তু অনিবার্য কারণে সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া হল, গান লিখলেন কাইফি আজমী আর শৈলেন্দ্র। সাময়িক ভেঙেও পড়েছিলেন। কিন্তু ছবিটা বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ার পরে বলেন, “ভাগ্যিস!”

দীর্ঘ কেরিয়ারে কাজ করেছেন নামী অনামী অনেক মিউজিক কম্পোজারের সঙ্গে। তবে কিংবদন্তি হয়ে রয়েছে আনন্দ আর লক্ষীকান্ত-প্যারেলাল জুটি। জুটিতে তৈরি করেছেন ১৬৮০টা গান! ৩০৩টি ছবিতে কাজ করেছে এই জুটি। ৯৯টি ছবিতে জুটি বেঁধেছিলেন রাহুল দেব বর্মনের সঙ্গে। ৩৪টি ছবি কল্যানজি-আনন্দজি জুটির সঙ্গে। রাহুল দেব বর্মনের সঙ্গে খুব ভাল বন্ধুত্ব ছিল। এমনকি যে সময়ে হাতে কাজ কমে এল রাহুলের তখন প্রচুর প্রযোজক এবং পরিচালককে বলেছেন রাহুল দেব বর্মনকে কাজ দেওয়ার জন্য!

এই লম্বা কেরিয়ারে বেশি পুরস্কার পাননি। তবে সত্তরের দশকে একজন নাকি ওঁকে বলেছিলেন যে ১১,০০০ টাকা দিলে একবছরের পুরস্কার পাওয়া যাবে। আনন্দ বলেছিলেন, “শুধু পুরস্কার পাব নাকি অনেক নতুন ছবিতে গান লেখার সুযোগও? শুধু পুরস্কারে আমার কোনও লোভ নেই”। এরপর একটা সময়ে সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলতে দেখে নিজেকে সরিয়ে নেন সমস্ত পুরস্কার মঞ্চ থেকে। নিজের সবথেকে বড় পুরস্কার বলতেন একটা ঘটনাকে। একবার একটা চিঠি পেয়ে জেনেছিলেন তাঁর লেখা একটা গান রেললাইনে আত্মহত্যা করতে যাওয়া একজনকে জীবনের পথ দেখিয়েছে:
“গাড়ি কা নাম, না কর বদনাম,
পটরি পে রখ কে সর কো।
হিম্মত না হার, কর ইন্তেজার,
আ লউট জায়ে ঘর কো।
ইয়ে রাত জা রহী হ্যায়,
উয়ো শুবহ্ আ রহী হ্যায়।।”

শেষে একটা ঘটনা বলি, একবার এক ইনকাম ট্যাক্স অফিসার একটা পার্টি দিলেন। আনন্দও আমন্ত্রিত। অনেকেই জানতেন যে আনন্দ খুব ভাল গান করেন। ইনকাম ট্যাক্স অফিসার তাঁকে কিছু গান শোনাতে বললেন। আনন্দ বলেন, “আজ আমার শরীরটা তেমন ভাল নেই, শুধু আমন্ত্রণ রক্ষা করতেই এসেছি। আজ গাইছি না, এরপর যেদিন আবার দেখা হবে সেদিন অবশ্যই গাইব”। তো সেই অফিসার বলে বসলেন, “বকসি জী, এটা ইনকাম ট্যাক্স অফিসারদের পার্টি। আমি যে আপনাকে গান গাইতে বলছি এটা কোনও ভক্তের অনুরোধ নয়, ইনকাম ট্যাক্স অফিসারের অর্ডার”। হাতের 555 সিগারেটে একটা সুখটান দিয়ে আনন্দ অফিসারকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা আপনার র‍্যাঙ্কটা কী?” অফিসার জানালেন, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার। আনন্দ বললেন, “এই শহরেই কমপক্ষে আরও ১০০ জনের বেশি ইনকাম ট্যাক্স অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার রয়েছেন আর সারা ভারতবর্ষে এমন হাজার হাজার অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার রয়েছেন। কিন্তু মুশকিলটা কী হয়েছে জানেন? লোকে বলে যে ভারতবর্ষে নাকি একটাই আনন্দ বকসি রয়েছে। অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার সাহেব, যেদিন আপনি এমন একটা র‍্যাঙ্কে পৌঁছবেন যেখানে আপনি ছাড়া কেউ থাকবে না সেদিন আপনি আমাকে অর্ডার করতে পারবেন। সেই দিন দরকারে আমি আপনার একার জন্য গাইব। কিন্তু তার আগে সাহেব, আপনাকে সেই র‍্যাঙ্কে পৌঁছতে হবে”। এই ছিলেন আনন্দ বকসি।

কত যে ছবিকে সমৃদ্ধ করেছেন তার হিসেব নেই। কিছু নাম বলতে গেলে যেগুলো অবশ্যই মনে আসে: আরাধনা, মিস্টার এক্স ইন বম্বে, জীবন-মৃত্যু, জুলি, কটি পতঙ্গ, অমর প্রেম, আন মিলো সাজনা, আজনবী, হীরা-পান্না, নমক হারাম, চুপকে চুপকে, গীত, সত্যম শিবম সুন্দরম, অনুরোধ, শান, ববি, লভ স্টোরি, রকি, মেহবুবা, বালিকা বধু, শোলে, তেরি কসম, দোস্তানা, কর্জ, বেতাব, অলগ অলগ, এক দুজে কে লিয়ে, ডর, মোহরা, মহব্বতেঁ, দিল তো পাগল হ্যায়, গুপ্ত, জখম্, পরদেশ, তাল, কচ্চে ধাগে, খলনায়ক, প্রেম, ইয়াদেঁ, গদর, নায়ক, অশোকা, মুঝসে দোস্তি করোগে, না তুম জানো না হম এবং অবশ্যই দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে।

Loading


Share It