মৃণাল সেনের আদর্শ আমি আমৃত্যু ধারণ করব: চঞ্চল চৌধুরী

Share It

অতনু রায়

তিনি এই উপমহাদেশের অন্যতম সেরা অভিনেতা। ‘মনপুরা’, ‘মনের মানুষ’, ‘আয়নাবাজি’ থেকে হালের ‘হাওয়া’ তাঁর উপস্থিতি সবসময়ই দিয়েছে চমক। অভিনেতা তথা গায়ক-চিত্রশিল্পী চঞ্চল চৌধুরী। মোবাইল স্ক্রিনেও তাঁর অবাধ যাতায়াতে তৈরি হয় ‘কারাগার’, ‘তাকদীর’ বা ‘মুন্সিগিরি’র মত শিল্প। দু’বার বাংলাদেশের জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী অভিনেতার প্রথম ভারতীয় ছবি ‘পদাতিক‘ মুক্তি পেল আজ। ফ্রেন্ডস কমিউনিকেশন প্রযোজিত এবং সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত মৃণাল সেনের জীবনীচিত্রে তিনি মৃণাল সেন। ছবি মুক্তির আগেই ‘দ্য কাউন্টার কালচার‘ এর সঙ্গে আড্ডায় চঞ্চল চৌধুরী বললেন অনেক না বলা কথা।

প্রশ্ন: সুচিন্ত চৌধুরী। পৃথিবীর কাছে চঞ্চল। আমি বলব অচিন্ত্য…

চঞ্চল: … (হেসে) অচিন্ত্য কিন্তু আমার এক ভাইয়ের নাম। আমার মেজদার নাম হচ্ছে অচিন্ত্য।

প্রশ্ন: আচ্ছা। তোমার সাফল্য অচিন্তনীয়। উপমহাদেশের অন্যতম সেরা অভিনেতা বললে অত্যুক্তি হয় না। দুই বাংলার সাংস্কৃতিক দূরত্ব আরও অনেকটা কমিয়ে দিয়েছ এক ঝটকায়। এই জার্নিটা নিয়ে যদি কিছু বল…

চঞ্চল: এটা যে আসলে আমি একা করি, তা নয়। আমি একটা কথা খুব বড় করে বলতে চাই এবং বিশ্বাস করি মন থেকে যে শিল্পের শক্তিটা আসলে অসীম। যে কাজটি ধর্ম পারেনা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলাদলির কারণে করা হয়না,  শিল্প সেই কাজটি করতে পারে। সমস্ত মানুষকে একটা প্ল্যাটফর্মে এনে একই ভাবনার মধ্যে ডুবিয়ে দেওয়ার কাজটা করতে একটা ভাল গান পারে, একটা ছবি পারে, সিনেমা পারে। সেই জায়গা থেকে আমরা কে কোন বাংলার বা পৃথিবীর কোন প্রান্তের মানুষ সেটা কোনও ব্যাপার নয়। যে শিল্পের জন্য আমাদের সাধনা অথবা যে কাজটা আমরা করছি বা দীর্ঘদিন ধরে করার চেষ্টা করছি সেই কাজের ফলাফল হচ্ছে ভাল কিছু করে সব মানুষকে এক জায়গায় আনতে পারা। সব মানুষ এসে আমাদের কাজ দেখেন এবং জাতি, ধর্ম, বর্ণ, রাজনীতি সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে। শিল্পের জায়গাটা কিন্তু তখন অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তুমি যেটা বললে, শিল্পই সেটা পারে। দুই বাংলাকে এক করতে পারে আমাদের এই কাজগুলো।

প্রশ্ন: চঞ্চল চৌধুরী মানুষটার কথা আমি জিজ্ঞাসা করছি না। অভিনেতা চঞ্চলের মধ্যে সত্যিই কি কোনও চঞ্চলতা আছে?

চঞ্চল: সেটা তো অবশ্যই আছে। আমি বলি, অভিনয় করার চেষ্টা করি। সেই চঞ্চলতা বাইরে কতটা আছে জানি না, তবে ভেতরে ভেতরে তো অবশ্যই আছে। কোনও কাজ যখন দর্শকদের খুব ভাল লাগে, দর্শক যখন বলেন ‘আপনার এই কাজটা দেখলাম খুব ভাল লাগল’, তখন তো নিজের ভেতরটা চঞ্চল হয়! সে ভাল লাগার চঞ্চলতা। এছাড়া ছোটবেলা থেকে হয়ত একটু দুষ্টুও ছিলাম, তাই আমার নামটা হয়ত চঞ্চল। তবে চঞ্চলতা আছে। আসলে চঞ্চল ছাড়া কি কিছু চলে?

প্রশ্ন: একেবারেই না…

চঞ্চল: কেউ যদি স্থির হয়ে যায় তাহলে সে এগোবে কীভাবে?

প্রশ্ন: কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে সাফল্যটা স্থির। এটা ‘কনস্ট্যান্ট’ যে, চঞ্চল চৌধুরী কোনও কাজে থাকা মানে সেই কাজ সফল হবেই।

চঞ্চল: (হাসি) সেটা কতটুকু হয়, না হয় জানিনা। কিন্তু যখন সফল হয়, তখন কিন্তু ওই সফলতা নিয়ে আমি আবার স্থির হয়ে যাই না। চেষ্টা করি যাতে আমার চঞ্চলতাটা চলতে থাকে।

প্রশ্ন: আজকে কলকাতায় বসে আমার মত হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষায় আছেন ‘পদাতিক’ দেখবেন বলে। এই আগ্রহ তো অভিনেতা চঞ্চলের অর্জন?

চঞ্চল: এটা আমি আমার সৌভাগ্য মনে করি।

প্রশ্ন: এটা তো এমনি এমনি হয় না। এই অর্জনের পিছনে কী কী ত্যাগ আছে?

চঞ্চল: ত্যাগ বলতে গেলে বলব, যে কোনও কাজ করতে গেলেই তো নিজের স্বার্থের কথাটা বাদ দিয়ে কাজের কথাটা আগে মাথায় রাখতে হয়। সেটা যে শুধু অভিনয়ের ক্ষেত্রে সেটা নয়, অনেক এরকম পেশা আছে। এই কাজগুলো যাঁরা করেন, সবার প্রতি আমি আমার শ্রদ্ধা জানাতে চাই। আমি যে কাজটা করছি, সেটা করতে গিয়ে স্ট্রাগলটা করতে হয়েছে ছোটবেলা থেকেই। প্রথমদিকের  স্ট্রাগলটা ছিল বেঁচে থাকার। পড়াশোনা করব, নিজের জীবনে কীভাবে সফল হব সেই যুদ্ধটা ছিল আর তার সাথে নিজের টিকে থাকার যুদ্ধ। তারপর নিজের শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা, সেটাও তো একটা সময় ভেতরে থাকে তারপর মুখে মুখে চলে আসে। এটাও একটা স্ট্রাগল যে আমি একটা কিছু পেলাম, তারপর মনে করতেই পারি যে আমার জীবনে যতটুকু অ্যাচিভমেন্ট হয়েছে এরপরে বোধহয় আমি আর অতটা স্যাক্রিফাইস না করে নিজের স্বার্থটা নিজে বুঝে নিতে পারলেই ভাল থাকব। সেই জায়গাটা তো আমি আসলে চিন্তা করছি না, আমি চিন্তা করছি যে কষ্ট করে হলেও যে কাজগুলো করেছি বা যে কাজগুলোর জন্য দর্শক আমাকে ভালবেসেছেন, তাঁদের এই ভালবাসার জন্য সম্মান জানানোটা আমার আমৃত্যু যেন থাকে। এটা কিন্তু দায়বদ্ধতা। শিল্পের প্রতি যেমন দায়বদ্ধতা থাকে, এই মানুষগুলোর প্রতিও কিন্তু আমার একটা দায়বদ্ধতা আছে। যাঁরা আমাকে বিশ্বাস করেন, তাঁদের আমার কাজের প্রতি যে আস্থা তৈরি হয়েছে সেটা যেন কোনোভাবেই ভেঙে না যায়।

প্রশ্ন: একজন অভিনেতা হিসেবে একজন কিংবদন্তি পরিচালকের জুতোয় পা। তোমার কী মনে হয়, যাঁর সঙ্গে কখনও সৌজন্য সাক্ষাৎ টুকুও হয়নি কিন্তু জানো যে তিনি নিজের বিশ্বাসের বাইরে ছবি করেননি। তাঁর মনন পড়তে কোনটা বেশি জরুরী? তাঁর লেখার ভাষা নাকি তাঁর ছবির ভাষা?

চঞ্চল: মৃণাল সেনের চরিত্রে অভিনয় করা আমার জন্য একই সঙ্গে কঠিন এবং দুর্বোধ্য একটা কাজ। আমি বলব, এটা আমার জন্য অসম্ভব দুঃসাহসিক একটা কাজও বটে। আমি যে এটা করতে পারব সেটা আমার কখনও মনে হয়নি। যাই হোক, সেটা করা গেছে। আমার এই চরিত্রে অভিনয় করার একটা লোভ তো অবশ্যই ছিল। কারণ, মানুষটার ছবি যতটুকু দেখেছি তাতে ওঁর ছবির দর্শন ব্যক্তিগতভাবে ভাল লাগত। যে ভাবে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ এবং তাদের জীবনের অধিকার নিয়ে ছবি বানাতেন, আমার খুব পছন্দের। যেহেতু আমার বাবা স্কুলশিক্ষক ছিলেন তাই ছোটবেলা থেকেই একটা আদর্শ নিয়ে বড় হয়েছি। সেই আদর্শের জায়গাটা অনেকটা মেলে মৃণাল সেনের সঙ্গে। তাই ওঁর জীবনদর্শন এবং ছবির ভাষা দুটোই আমার ভীষণ পছন্দের।

প্রশ্ন: তুমি থিয়েটারের মানুষ। তাই মৃণাল সেন যে ধরণের ছবি বানিয়েছেন সেই ধারার ছবি তোমার চর্চার বিষয় নিশ্চিত ভাবেই থেকেছে। কিন্তু ‘নিশ্বাসে চঞ্চল, বিশ্বাসে মৃণাল’ পর্ব কাটিয়ে ওঠার পর তোমার মৃণাল সেন সম্পর্কে ধারণা কতটা পাল্টেছে?

চঞ্চল: মৃণাল সেন হয়ে ওঠা তো কখনওই সম্ভব নয়। দুজন যেহেতু সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। আমি চেষ্টা করেছি অভিনেতা হিসেবে, এটুকুই বলতে পারি। দেখতে কাছাকাছি হলেই তো আর হয় না! ভেতরের মানুষটাকে ছুঁতে হয়, ধারণ করতে হয়। সেটা খুবই কঠিন কাজ। তারপরেও সৃজিতদা আমাকে দিয়ে চেষ্টা করিয়েছেন। আমিও সিনেমার বাইরে গিয়ে ব্যক্তি মৃণাল সেনকে নিয়ে একটু চর্চা করেছি। তথ্য, ভিডিও, বইয়ের বিরল এক সম্ভার সৃজিতদা আমাকে দিয়েছিলেন মৃণাল সেন সম্পর্কে জানার জন্য, যাতে আমি মানুষটি হয়ে উঠতে পারি। এবার কতটা পেরেছি, সেটা দর্শক যখন ছবিটা দেখবেন তখন বুঝতে পারবেন। সৃজিতদা আমাকে দিয়ে চেষ্টাটা করিয়েছেন আর আমি চেষ্টাটা করেছি। তবে অভিনয় করতে গিয়ে ওঁর সম্পর্কে যখন জেনেছি ওঁকে ধারণ করার জন্য সেটা অনেক কাজে লেগেছে এবং মৃণাল সেন সম্পর্কে ধারণাটাও অনেকটা পাল্টেছে।

প্রশ্ন: সত্যিই কি মৃণাল সেনকে পুরোটা ছেড়ে বেরোতে পেরেছ? নাকি ‘পদাতিক’ তোমার মননে অনেকটা মৃণাল রেখে দিয়ে গেল?

চঞ্চল: একটা চরিত্র থেকে বের হতে একটু তো সময় লাগেই। যেসব মৌলিক চরিত্রে অভিনয় করি সেগুলো থেকে বেরোতেই আমার অনেকটা সময় লেগে যায়। আর মৃণাল সেনের মত একজন রক্তমাংসের আদর্শিক মানুষের চরিত্রে অভিনয় করা, তাঁর সম্পর্কে জানা এবং ভেতরে তাঁকে ধারণ করার পর তো সহজে বেরিয়ে আসা যায় না! হয়ত চরিত্রটা থেকে আমি বেরিয়ে এসেছি কিন্তু কিংবদন্তি ওই মানুষটার আদর্শটা আমার ভেতরে থেকে গেল। ওঁর কাজ আমি আগে দেখেইছিলাম কিন্তু ছবিটা করতে গিয়ে আরও বেশি করে দেখেছি। অনেক ছবি একাধিকবার দেখেছি ওঁকে চেনার জন্য, আদর্শের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য। সেই আদর্শ তো ভেতরে থেকেই যাবে, সেটুকু আমি আমৃত্যু ধারণ করব।

প্রশ্ন: চঞ্চলদা, একটু স্বপ্নের জগতে যাই। তুমি এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে একটু চোখ বুজে বসে আছ। চোখ খুলেই সামনে ওঁকে বসে থাকতে দেখলে। উঠে গিয়ে প্রণাম করলে। কাঁধে হাত রেখে মৃণাল সেন বললেন, ‘তোমার অভিনয় বেশ ভাল। আমি আমার একটা ছবি নতুন ভাবে বানাব ভাবছি, তোমাকে নেব। তুমি বল, আমার কোন ছবিটা করবে?’ কী বলবে?

চঞ্চল: মৃণাল সেনের চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে আমার প্রায়ই মনে হত যদি কখনও ওঁর সঙ্গে দেখা হত বা কাজ করার সুযোগ হত তাহলে অবশ্যই নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে করতাম। স্বপ্নেও যদি কখনও ওঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তখনও বলব, ‘আমি আপনার সঙ্গে কাজ করতে চাই। এটা আমার জন্য অনেক সৌভাগ্যের ব্যাপার হবে।’ সত্যিই! যদি পারতাম!

প্রশ্ন: শিল্পীরা হয়ত সবথেকে বেশি ভয় পান ভাবনা হারিয়ে ফেলার। মাথায় কোনও ভাবনা এলে মৃণাল বাবু লিখে রাখতেন। শিল্পী চঞ্চল চৌধুরী হারানোর ভয় পান?

চঞ্চল: হ্যাঁ, আমারও মাঝেমধ্যে অনেক ভাবনা মাথায় আসে, আবার বেরিয়েও যায়। আমারও অভ্যেস আছে আমি সেগুলো কাগজে লিখে রাখি, কারণ আমি একটু ভুলোমন। আবার কখনও ইচ্ছে করেই লিখে রাখি না। কারণ, সব ভাবনা তো আর সত্যি হয় না! যে ভাবনাগুলো এলে আমার মনে হয় আমি কাজটা আমি করব বা করা সম্ভব, তাহলেই সেটা আমি লিখে ফেলি।

প্রশ্ন: তুমি তো শিকাগো গেছ। মৃণাল সেনের বহু স্মৃতি শিকাগোর লাইব্রেরিতে। দেখার সুযোগ পেয়েছ?

চঞ্চল: আমি এই বছরের বঙ্গ সম্মেলনেই প্রথম শিকাগো গেলাম। সময়ের অভাবে ওঁর স্মৃতি বিজড়িত জায়গাগুলোতে যাওয়া হয়নি। এরপরে গেলে আমি অবশ্যই যাব। তবে, মৃণাল সেনের ছেলে কুণাল সেনের সঙ্গে এবার আমার শিকাগোয় দেখা হয়েছে। বেশ কিছুটা সময় একসঙ্গে কাটিয়েছি। ওখানে সৃজিতদা, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, মমতা শঙ্কর, আমি আর কুণাল সেন একটা আলোচনা সভায় যোগ দিয়েছিলাম মৃণাল সেনকে নিয়ে। আমার সৌভাগ্য কুণাল সেনের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটাতে পেরেছি। এটা আমার একটা ইচ্ছেপূরণ বলতে পারো। মৃণাল সেনের সঙ্গে তো দেখা হল না, ওঁর সন্তানের সঙ্গে দেখা হয়ে ভাল লেগেছে।

প্রশ্ন: মৃণাল সেনের ব্যবহার করা টেবিল-চেয়ার-মেঝে, তাকিয়ে থাকার জানালা-সিলিং ছুঁয়ে থাকা একজন অভিনেতার কাছে ‘শ্লাঘা’ নাকি অন্য কিছু?

চঞ্চল: ‘পদাতিক’ ছবিতে মৃণাল সেনের বেশ কয়েকটা বয়স দেখানো হয়েছে। তার মধ্যে শেষে বয়সের অংশের শুটিংটা একটা বাড়িতে হচ্ছিল। আমি প্রায় দেড় ঘন্টা পরে জানতে পেরেছিলাম যে ওটা ওঁরই বাড়ি যেখানে উনি শেষ জীবনটা কাটিয়েছেন। এর আগে উনি যে সময় যে বাড়িটায় থাকতেন অনেক ক্ষেত্রেই তা সেট বানিয়ে বা পুরনো বাড়ি ভাড়া নিয়ে শুটিং করা হচ্ছিল। আমি ভেবেছিলাম, ওটাও বোধহয় সেট বা সেরকমই কোনও ভাড়ার বাড়ি। আমি বারবার সৃজিতদাকে বলছিলাম যে, বাড়ির সেটটা খুব সুন্দর বানানো হয়েছে। মৃণাল সেনের বেশ কিছু ছবি ছিল, গীতা সেনের ছবি ছিল, ওঁর লাইব্রেরীর মধ্যে কিছু অ্যাওয়ার্ড যেটার মধ্যে বাংলাদেশের এফডিসির একটি অ্যাওয়ার্ডও ছিল! তখন সৃজিতদা আমাকে বললেন, “এটা সেট নয়, এটা মৃণাল সেনের বাড়ি। উনি এই বাড়িতেই শেষ জীবনটা কাটিয়েছেন। আপনি যে চেয়ারটায় বসে অভিনয় করছেন, ওই চেয়ারটাতেই উনি বসতেন।”

প্রশ্ন: এটাও তো সিনেমা! রোমহর্ষক!

চঞ্চল: তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, আমার নিজেরই তখন বিশ্বাস হচ্ছিল না! ওই স্পর্শটুকু যে আমাকে কী শক্তি দিল, কী পরিমাণ আত্মবিশ্বাস দিল বলে বোঝাতে পারব না। অসুস্থ হওয়ার পরে হাসপাতাল থেকে আনা যে বিছানায় উনি শুতেন এবং শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন, সেই বিছানায় শুয়ে আমি যখন শুটিং করছিলাম, মুহূর্তটা আমি সত্যিই ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না। অন্যরকম একটা অনুভূতি হচ্ছিল, একটা শক্তি পাচ্ছিলাম। এত ভাল লাগছিল! ওঁর সঙ্গে তো দেখা হল না, অন্তত ওঁর বাড়িতে এসে কাজ করতে করতে ওঁর কিছু স্পর্শ পেলাম, আশীর্বাদ পেলাম। আর তখন থেকেই আমি একটা অন্যরকম ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। আলাদা একটা উত্তেজনা। তখন যদিও বা বেশ কয়েকদিনের শুটিং হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তারপরের বাকি শুটিংয়ে আমি সত্যিই একটা ধ্যানের মধ্যে থাকার মত অবস্থায় ছিলাম। আত্মবিশ্বাসটা ভীষণ বেড়ে গিয়েছিল। ওই স্পর্শটা, ওঁর ব্যবহৃত জিনিস, শোয়ার খাট, ওই ঘরের মধ্যে হাঁটতেন, ওঁর লাইব্রেরী, ড্রয়িং রুম সবকিছু আমাকে অন্য একটা অনুভূতি দিচ্ছিল। যে অনুভূতি শ্রদ্ধার, ভালবাসার, আশীর্বাদের স্পর্শের।

প্রশ্ন: অনেক বিদগ্ধ অভিনেতা বলে থাকেন, মঞ্চ একজন অভিনেতাকে লালন করে। অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীর উত্তরণে মঞ্চ কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে?

চঞ্চল: আমি মনে করি আমার অভিনেতা হয়ে বেড়ে ওঠাটা কেউ যদি স্বীকার করেন, সেটার পিছনে সবথেকে বড় গুরুত্ব রয়েছে মঞ্চের। মঞ্চ থেকেই আমার অভিনয়ে হাতে খড়ি, আমার শেখা। তার পরে মাধ্যম অনুযায়ী বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে সেই শিক্ষাটাকে আমি অন্য মাধ্যমের উপযুক্ত করে তোলার চেষ্টা করেছি। মঞ্চের কাজের একটা ধরণ আছে, ২০০-৫০০ দর্শকের সামনে অভিনয় করা। অভিনয়ের মূলসূত্রটা তো এক। কিভাবে অভিনেতা হয়ে উঠতে হয় বা কিভাবে চরিত্র নির্মাণ করতে হয় সেই ফর্মুলাটা তো আসলে কমন। এবারে আমি যখন টেলিভিশনে অথবা সিনেমায় অভিনয় করছি তখন সেই জায়গার টেকনিক্যাল বিষয়টা মাথায় রেখে অভিনয় করছি। কিন্তু সূত্রটা তো একই। সেই সূত্রটিই আমার শেখা মঞ্চ থেকে। তাই মঞ্চের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা সবথেকে বেশি। আর মঞ্চের পাশাপাশি যে ব্যাপারটা আমাকে সব থেকে বেশি সাপোর্ট দিয়েছে সেটা আমার চারুকলা নিয়ে পড়াশোনাটা। আমার কল্পনা শক্তি চারুকলার শিক্ষা বাড়িয়ে দিয়েছে…

প্রশ্ন: …আমার প্রশ্নের মধ্যে এটা ছিলও। তুমি এত সুন্দর ছবি আঁকো। ছবি চিত্রশিল্পীর নির্বাক অভিব্যক্তি। অভিনয়, সেও এক অভিব্যক্তি, পর্দায় ছবি আঁকা। আঁকিয়ের মন অভিনেতা চঞ্চলের সহযোগিতা করে কখনও?

চঞ্চল: একদম। আমি আগে হয়ত দেখতাম না সেইভাবে আর দেখার সুযোগও ছিল না। যখন সিনেমা, বিজ্ঞাপন ৩৫এমএম-এ শুট হত, তখন তো এক শট্ দ্বিতীয়বার দেখার সুযোগ হত না, তখন একটা শট্ দিলাম, পরিচালক ‘ওকে’ বলতেন তো ‘ওকে’ আর ‘এনজি’ বললে আরেকবার হয়ত টেক দিতে হত। আর এখন যতক্ষণ পর্যন্ত অভিনেতা বা পরিচালক সন্তুষ্ট না হন ততক্ষণ কিন্তু সেই শটটা দিতে হয়।

প্রশ্ন: ডিজিট্যাল মাধ্যমে যেটা হয়…

চঞ্চল: …হ্যাঁ, ডিজিট্যাল মাধ্যমের যে সুবিধাটা। সেটা কিন্তু আমি দেখি একটা শট দেওয়ার পরে যে আমি ভিতরে যেটা ফিল করলাম, আমার এক্সপ্রেশনে সেটাই এল কিনা! পরিচালক হয়ত বললেন যে, ‘হ্যাঁ হয়েছে, ঠিক আছে’। কিন্তু ওই ‘ঠিক আছে’ টার সঙ্গে আমি একমত হই না। পরিচালক যেন খুব কনফিডেন্টলি বলেন যে, হ্যাঁ! ঠিক আছে। তখন আমি অন্য একটা শটে যাই এবং আমি দেখি। আমি রিক্যুয়েস্ট করি তাঁদের, এজন্য আমার অনেক সহ অভিনেতা বলেন যে, ‘তুমি তোমার শট বারবার টেনে টেনে দেখো কেন?’ আমি বলি, আমার ভুল ধরার জন্য। আমি আমার কাজ যখন স্ক্রিনে দেখি তখনও প্রথম দেখাটা থাকে একদমই আমার ভুল বা ঐ কাজের কোথাও কোনও গ্যাপ আছে কিনা ধরার জন্য। আমি আমার নিজের বিবেচনায় যতটুকু বুঝি আর কি। এবার আমার যদি কাজটা দেখে মনে হয় যে হ্যাঁ, ৮০-৯০ শতাংশ ঠিক আছে তারপরে আমি দর্শকের দৃষ্টিতে দেখা শুরু করি। প্রথমবার আমি নিজের কাজ দর্শকের দৃষ্টিতে দেখি না। অন্যের কাজ যখন দেখতে যাই তখন দর্শকের মতই দেখি।

প্রশ্ন: মানে একটা আত্মসমীক্ষার ব্যাপার থাকে?

চঞ্চল: হ্যাঁ, আত্মসমীক্ষার একটা ব্যাপার আছে আমার। চারপাশে দর্শকের রেসপন্স হয়ত দেখলাম সবাই ভাল বলছেন। কেন ভাল বলছেন? কেন তাদের ভাল লাগল? কাজটা আসলেই এত ভাল হয়েছে কিনা বা এতটা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য কিনা কাজটা বা আমি, সেটা তো দর্শক হিসেবেও আমাকে একটু যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে।

প্রশ্ন: কিন্তু যত সহজে বললে, একবার আত্মসমীক্ষা হিসেবে আর একবার দর্শক হিসাবে, একজন অভিনেতার কি কাজটা অতটাও সোজা হয়? এই শিফটিংটার জন্য তো একটা আলাদা রকমের অধ্যাবসায়ের প্রয়োজন হয়!

চঞ্চল: এটা খুব কঠিন কাজ। কারণ, আমরা সবসময়ই একটা আত্মতৃপ্তিতে ভুগি তো! নিজের সবকিছুই আমরা মনে করি যে আমি যেটা করছি সেটা ঠিক।

প্রশ্ন: একদমই। সেটা তো থাকেই…

চঞ্চল: …আগে যখন সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না, নিজের বিচার নিজেই করতাম, নিজের ডিসিশন নিজেই নিতাম। কিন্তু এখন তো যেকোনো কাজ করলে একটু খারাপ হলে সেটা তো ভীষণ খারাপ হয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। আবার একটু ভাল কেউ করলে অনেক ভাল হিসেবে দর্শক সেটা প্রকাশ করে। এটার একটা যন্ত্রণাও আছে। এটা সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে আরও বেশি হয়েছে। কিন্তু যখন সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না তখন যে মানসিকতায় আমি নিজের কাজ দেখতাম, এখনও তাই দেখি। আত্মতৃপ্তিতে আমি ডুবে যাই না।

Loading


Share It