ক্রাইম ড্রামা ও সাই-ফাই মিশেলে আসছে অভিজিতের ‘ধ্রুবর আশ্চর্য জীবন’

Share It

সোমনাথ লাহা

পদার্থবিজ্ঞানের একটি অন্যতম হাইপোথেসিস হল সম্ভবনা। সেই সম্ভবনা একটি কোয়ান্টাম স্টেটের কথা বলে। ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে দুটি আলাদা আলাদা ঘটনা যদি ঘটে তাহলে তার ফলাফল‌ও ভিন্ন হয়। জীবনকেও যদি ঠিক সেভাবেই চারটি অধ্যায়ে ভাগ করা হয়, তাহলে গড়ে ওঠে চার ধরণের সম্ভবনা। প্রতিটি সম্ভবনা নিয়ে তৈরি হয় চারটি ভিন্ন জগৎ। ফলস্বরূপ জীবনের চারটি অংশ‌ও ভিন্ন ভিন্ন রূপে ধরা দেয়।

এমন‌ই বিষয়ভাবনাকে এবার সেলুলয়েডে তুলে ধরেছেন পরিচালক অভিজিৎ চৌধুরী, তাঁর ছবি ‘ধ্রুবর আশ্চর্য জীবন’-এর মধ্যে দিয়ে। ক্রাইম ড্রামা ও সায়েন্স ফিকশনের মিশেলে আবর্তিত এই ছবি আসলে ছবির মুখ্য চরিত্র ধ্রুবর জীবনের চারটি সম্ভবনা, চার জগতের আশ্চর্যময় আখ্যান। আর সেই জীবনের ভিন্ন ভিন্ন রূপের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছেন চার কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী। তাঁরা হলেন যামিনী রায়, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিকাশ ভট্টাচার্য ও বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়। ছবিতে কোথাও গিয়ে এই চারজন শিল্পী ও তাঁদের শিল্পকলা রূপকের আঙ্গিকে জড়িয়ে যায় ধ্রুবর জীবনের সঙ্গে। ধ্রুবর জীবনের চারটি অধ্যায় কিভাবে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত? চারটি জীবনের মধ্যে দিয়ে কি সমান্তরাল বিশ্বে উঁকি দেওয়া যাবে?

এই ছবির হাত ধরে পরিচালক পর্দায় যেমন জীবনের আবেগ, আকাঙ্ক্ষা এবং জীবনে রূপদানকারী মুহুর্তগুলির গভীরে মনোনিবেশ করেছেন, তেমন‌ই ইন্ডিপেন্ডেন্ট বাংলা ছবিতে প্রথমবার মাল্টিভার্সের মতো ভাবনাকে নিয়ে এসেছেন। সেই কারণেই ছবিতে উন্নত ও বুদ্ধিদীপ্ত ভিএফ‌এক্সের ব্যবহারেও এতটুকু কার্পণ্য করেননি। বাংলা ছবির ক্ষেত্রে এটাও এক বিরলতম বিষয়‌ই।

দৈনন্দিন জীবন থেকে উঠে আসা এই গল্পের মধ্যে দিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখোমুখি সকলকে দাঁড় করিয়েছেন অভিজিৎ চৌধুরী। মধ্যবিত্ত আমাদের এই জীবন দাঁড়িয়ে রয়েছে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাশূন্যদের মাঝখানে। সঙ্কটজনক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে তাই জীবনে প্রায়শই সন্মুখীন হতে হয় এক প্রশ্নের। জীবনে বেঁচে থাকব নাকি আদর্শকে আঁকড়ে ধরে থাকব? কোন পথে যাওয়া উচিত?

ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র ধ্রুব। প্রেমিকা রিমির পরিবারকে বাঁচাতে গিয়ে এক জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় সে। বুঝতে পারে রিমিদের অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু টাকা জোগাড় করতে গেলে তাকে অপরাধ করতে হবে। কিন্তু রিমি চায় না ধ্রুব খারাপ কাজের মধ্যে জড়িয়ে পড়ুক। শুরু হয় দ্বন্দ্ব। ধ্রুব দুটি পথের মধ্যে কোনটিকে বেছে নেবে? সমাজের চোখে কোনটা অপরাধ এবং কোনটা নয়? নৈতিক এই টানাপড়েনে ধ্রুবর জীবন কখনও ডুবে যায়, কখনও ভেসে যাওয়া নিয়ে এগিয়ে চলে ছবির গল্প।

ছবিতে ধ্রুবর চরিত্রে অভিনয় করেছেন ঋষভ বসু। টলিপাড়ায় অভিনয়গুণে ইতিমধ্যেই বেশ পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন অভিনেতা। রিমির ভূমিকায় দেখা যাবে ঋত্বিকা পালকে। ঋত্বিকাকে ইতিমধ্যেই দর্শকরা দেখেছেন ‘কিয়া অ্যান্ড কসমস’, ‘লক্ষ্মী ছেলে’-র মতো ছবিতে। এছাড়াও ছবিতে অন্যান্য চরিত্রে রয়েছেন কোরক সামন্ত, আনন্দরূপা চক্রবর্তী, বাদশা মৈত্র, সুদীপ মুখোপাধ্যায়, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, সেঁজুতি মুখোপাধ্যায়, যুধাজিৎ সরকার, দীপক হালদার, দেবাশিস বিশ্বাস, শান্তনু নাথ, প্রেরণা দাস, অরুণাভ খাসনবিশ প্রমুখ।

ফোর্থ ফ্লোর এন্টারটেনমেন্ট ও কনসেপ্ট কিউবের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত এই ছবির প্রযোজক নীলারুণ বসু ও কল্যাণ সুন্দর গায়েন। চিত্রনাট্য লিখেছেন অভিজিৎ নিজেই। কাহিনি লিখেছেন আলেখ্য তলাপাত্র ও পরিচালক স্বয়ং। ছবির সঙ্গীত ও আবহ পরিচালনা করেছেন নবীন প্রজন্মের শিল্পী প্রলয় সরকার। ছবিতে প্রলয়ের সুরে প্লেব্যাক করেছেন তিমির বিশ্বাস। এছাড়া ছবিতে একটি পুরাতনী বাংলা গান গেয়েছেন গোবিন্দ মৌলিক। সম্পর্কে যিনি প্রলয়ের সঙ্গীত শিক্ষাগুরু। ছবির একেবারে শেষ মুহূর্তে তৈরি হ‌ওয়া গান ‘তোমায় গান শোনায়’। সারেগামা-র ইউটিউবে মুক্তিপ্রাপ্ত এই গানটি ইতিমধ্যেই যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে দর্শকমহলে। গানটি গেয়েছেন অনির্বাণ দাশগুপ্ত (ঋজু), আনিস আহমেদ ও প্রলয় স্বয়ং। ছবির সিনেমাটোগ্রাফার অর্ণব লাহা। সম্পাদনায় সুরমিত চট্টোপাধ্যায় ও পরিচালক স্বয়ং।

আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি বড়পর্দায় মুক্তি পেতে চলেছে এই ছবি। ছবির নিবেদক প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী। প্রসঙ্গত, শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বিই পাশ অভিজিৎ চৌধুরী একজন ফুলব্রাইট স্কলার। তিনি ড্রেক্সেল ইউনিভার্সিটি, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির টিশ স্কুল অফ আর্টস এ স্ক্রিপ্ট রাইটিং এবং ভারতীয় চলচ্চিত্র নিয়ে শিক্ষকতার কাজ করেছেন। এক সময়ে সিনেমার প্রতি থাকা তাঁর নেশাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। সেইজন্য চাকরি ছেড়ে টলিউডে শুরু করেন লড়াই। জনপ্রিয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হ‌ইচ‌ই-তে ‘মানভঞ্জন’, ‘আস্তে লেডিস’, ‘একেনবাবু ও ঢাকা রহস্য’-র পাশাপাশি ’টুরু লাভ’-এর মতো মিনি সিরিজ‌ও তাঁর কাছ থেকে পেয়েছেন দর্শকরা। এছাড়াও ক্লিক ওটিটি প্ল্যাটফর্মে তাঁর পরিচালিত ‘জনি বনি’ সিরিজটিও দর্শকদের মন জয় করেছিল।

অভিজিৎ এবার ‘ধ্রুবর আশ্চর্য জীবন’ এর হাত ধরে দর্শকদের নতুনত্বের স্বাদ দিতে চলেছেন বড়পর্দায়। ইতিমধ্যেই ৩০তম আন্তর্জাতিক কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে বেঙ্গলি প্যানোরামা বিভাগে শ্রেষ্ঠ ছবি হিসাবে পুরস্কৃত হয়েছে ছবিটি। শুধু তাই নয়, ছবিটিকে ঘিরে চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেপ্রেমী ও দর্শকদের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। ছবিটি রীতিমতো প্রশংসিত ও সমাদৃত হয়েছে। পাশাপাশি আটলান্টা ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে শ্রেষ্ঠ পরিচালক এবং এন‌এবিসি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে শ্রেষ্ঠ পরিচালক সহ শ্রেষ্ঠ অভিনেতার স্বীকৃতি ঝুলিতে জমা পড়েছে এই ছবির। সম্প্রতি প্রকাশ্যে এল ছবির ট্রেলার ও গান। প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ছবির প্রযোজক, পরিচালক সহ অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং কলাকুশলীরা।

ছবিতে চারজন কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী যামিনী রায়, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিকাশ ভট্টাচার্য ও বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে পরিচালক বলতে চেয়েছেন জীবনটাকে আমরা যেভাবে দেখে থাকি সেটাই কি আসলে জীবন? নাকি এর অন্যরকম একটা মানে আছে? সেটাই এঁরা ভেবেছিলেন। কারণ ইউরোপিয়ান আর্টে প্রশিক্ষিত যামিনী রায় পরবর্তী সময়ে দেশীয় পটচিত্রকে তাঁর ছবির প্রধান বিষয় হিসেবে বেছে নেন। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর কিউবিজম নিয়ে কাজ শুরু করলেও তিনি পলিটিক্যাল কার্টুনিস্ট হিসেবেও তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিকে তুলে ধরেছিলেন। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের ম্যুরাল আর্ট আজও বিস্মিত করে সকলকে। দৃষ্টিশক্তি হারিয়েও অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে তিনি অবিচল ছিলেন শিল্পসৃষ্টিতে। অপরদিকে বিকাশ ভট্টাচার্য, তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে বিভিন্ন শৈলী নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেও ডল সিরিজের মধ্যে দিয়ে সমাজের অন্ধকার দিক ও অস্বস্তিকর বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলেছেন। তাই ছবির কাহিনিতে একেকটি অধ্যায়ের সঙ্গে এই বরেণ্য চিত্রশিল্পীদের বহুমুখী ভাবনাকে যুক্ত করেছেন পরিচালক।

ছবি প্রসঙ্গে পরিচালক অভিজিৎ চৌধুরী বলেন, “এটা আমার অনেকদিনের জমে থাকা ভাবনা। অনেকখানি সময় দিতে হয়েছে ছবিটা করার জন্য। সেই কারণেই দু’বছর সময় লেগেছে আমার এই ছবিটা করতে। ছবির ভিএফ‌এক্স, ভিস্যুয়াল ডিজাইন থেকে শুরু করে সাউন্ড ডিজাইন, মিউজিক, এই সব নিয়ে প্রচুর চাপ ছিল। সকলে প্যাশন নিয়ে দিনের পর দিন মাসের পর মাস কাজ করে গিয়েছেন। এজন্য আমার কাস্ট আর ক্রু’কে আমি সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দেব। কারণ দু’বছর ধরে তাঁরা আমাদের পাশে রয়েছেন। এক‌ইসঙ্গে ধন্যবাদ দেব প্রযোজকদের, যাঁরা এমন একটা বিষয় নিয়ে কাজ করার জন্য এগিয়ে এসে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।” তবে ছবির ভাবনা লকডাউনে বুনেছেন পরিচালক। তাঁর কথায়, “সেই সময় আমার মনে হয়েছিল বেঁচে থাকার জন্য নিজের আদর্শকে ভাঙতে হবে। মধ্যবিত্ত জীবনের এই সঙ্কটময় মুহূর্তেই আমাকে ভাবতে হয়েছিল, আমি জীবনে বেঁচে থাকব নাকি আদর্শকে আঁকড়ে ধরে থাকব! ধ্রুব‌ও ঠিক এইরকম একটা টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যায়।”

ছবিতে চারজন শিল্পীকে ট্রিবিউট নিয়ে পরিচালক বলেন, “ছবিতে চারটি অধ্যায়ে চারটি সম্ভবনার কথা বলা হয়েছে। এমন দুনিয়া এক নিয়তি আর দুই শিল্পী তৈরি করতে পারেন। আমরা তাই চারজন এমন শিল্পীকে বেছে নিয়েছি যাঁরা কেরিয়ার জীবনে এই নিয়ে ভেবেছেন যে আমরা আপস করব নাকি করব না!” ছবিতে ধ্রুবর চরিত্রে ঋষভকে নির্বাচন করা নিয়ে অভিজিৎ-র মন্তব্য, “ঋষভের মধ্যে একটা অদ্ভুত রকমের নিরাপত্তাহীনতা রয়েছে। ও কখন‌ও খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে, কখন‌ও ভেঙে পড়ে। আবার কখনও প্রচন্ডরকম পজিটিভ থাকে। ওর সঙ্গে ধ্রুবর একটা মিল রয়েছে। ঋষভের মধ্যে ওই নৈতিকতা বিষয়টা কাজ করে। তাই আমার মনে হয়েছে এই চরিত্রে ওর থেকে যথাযথ আর কেউ হতে পারত না।”

ছবি প্রসঙ্গে রীতিমতো উৎসাহিত ঋষভ বলেন, “এটা এমন একটি ছবি যেটা আমি খুব ভালবেসে, আনন্দের সঙ্গে করেছি। ছবিতে আমি শুধুমাত্র অভিনেতা হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকিনি। ছবির প্রোডাকশনের কাজেও হাত লাগিয়েছি। সেটা প্রোডাকশন টিম তৈরি করা হোক, কিংবা শেডিউল করা, ক্রাউড ম্যানেজমেন্ট, সব কাজ করেছি।” পরিচালক সম্পর্কে অভিনেতার মত, “কিছু পরিচালক রয়েছেন যাঁদের সঙ্গে আমার ওয়েভলেন্থ ম্যাচ করে। অভিজিৎদা সেইরকম একজন পরিচালক। আমাদের কথাবার্তা, ভাবনাচিন্তা, সিনেমা দেখা মিলে যায়। সেটার ছবিতেও প্রতিফলন ঘটেছে। ‘টুরু লাভ’-এর সময় থেকে অভিজিৎদার সঙ্গে আমার পরিচয়। এটা আমাদের একসঙ্গে করা দ্বিতীয় কাজ। অভিজিৎদা যখন আমাকে এই গল্পটা শোনায় আমার অদ্ভুত লেগেছিল। আমি নিজে বিকাশ ভট্টাচার্যের কাজের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না। এই ছবির সূত্র ধরে ওঁর বিষয়ে জানা সম্ভব হয়েছে। ফলে আমার জানার পরিধি বিস্তৃত হয়েছে।”

পাশাপাশি ঋষভের কথায়, “এই ছবিতে কাজ করে আমি অভিনেতা হিসেবে প্রাপ্তমনস্ক হয়েছি।” এক‌ইসঙ্গে সাই-ফাই কল্পবিজ্ঞানের ছোঁয়া থাকলেও ছবির মধ্যে যে বাণিজ্যিক মোড়ক ও বিনোদনের প্যাকেজ রয়েছে সেটা দর্শকদের আনন্দ দেবে বলেই মনে করেন তিনি। কারণ, কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রচুর মানুষকে এই ছবির ইমোশনাল দিকটা বেসিক স্তরে ছুঁতে পেরেছে। তাঁর স্বাক্ষী থেকেছেন অভিনেতা স্বয়ং। তাঁর আর‌ও অভিমত, “ছবির বিষয়বস্তু মাটির কাছাকাছি থাকলে সেটা মানুষকে অনেক বেশি আকর্ষণ করে। এই ছবি বাংলার শিকড়, বাংলার মানুষের কথাই বলেছে।”

ছবিতে ধ্রুবর ছোটবেলার বন্ধু নন্দীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন কোরক সামন্ত। কোরকের কথায়,”আমি এই ছবিতে কাজ করে ভীষণ আনন্দ পেয়েছি। এইভাবে একটা ছবিকে ভাবা যেতে পারে এটা আমার ধারণায় ছিল না। দেড় বছর আগে অভিজিৎদা যখন প্রথম আমাকে গল্পটা বলে এবং চিত্রনাট্য পড়ে শোনায় মাথায় পুরো তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল। ফাইন আর্টস এমন একটা বিষয়, অডিও ভিস্যুয়াল মাধ্যমে কিভাবে সেটার মূল্যায়ন করব, উপভোগ করব, অনেক সময় বুঝে উঠতে পারি না। ছবিতে চারজন শিল্পীর ধারা সেগুলোকে একটা গল্প ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। দৃশ্য শ্রাব্য মাধ্যমে এই বিষয়টি আমার কাছে নতুন ছিল। আমার ধারণা এটা দর্শকদেরও অন্যরকম রসদ দেবে।” ছবিতে নিজের চরিত্র নিয়ে অভিনেতা বলেন, “নন্দী ধ্রুবর ছোটবেলার বন্ধু। কিন্তু দুজন একেবারে আলাদারকম, আলাদা শ্রেণিতে বড় হয়ে ওঠা মানুষ। অনেক সময় জীবনে ধ্রুব যখন দিশা খুঁজে পায় না তখন নন্দী তখন তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। কিন্তু এর ফলে বিপদ‌ও বাঁধায়। নন্দী ও ধ্রুবর এই পারস্পরিক রসায়ন উভয়কেই কোথায় পৌঁছে দেয় সেটা জানতে হলে ছবিটা দেখতে হবে।”

ঋত্বিকার কথায়, “এই ছবিতে একটা চরিত্রের হাত ধরে অনেকরকম চরিত্র হতে পেরেছি। সেটা খুব আকর্ষণীয় ছিল আমার কাছে। চরিত্রটা করতে গিয়ে আমার মনে হয় না পর্দায় হেসেছি। রিমির জীবনটা খুব কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যায়। ঐ ট্র্যাজিক সময়টাকে ধরা খুব কঠিন ছিল। আমার চরিত্রটি পর্দায় অনেকক্ষণ দেখা যায় না। ছবির শেষের একটা রূপে পর্দায় আমাকে অন্যরকম ভাবে দেখতে পাবেন দর্শকরা। চরিত্রটা চ্যালেঞ্জিং ছিল। তাই কাজ করে আমি খুব আনন্দ পেয়েছি। অভিজিৎদার সঙ্গে এটা আমার প্রথম কাজ। ছবির চিত্রনাট্যের কাঠামো শুনে আমি রীতিমতো ছিটকে গিয়েছিলাম। আমি নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবান বলে মনে করছি। এমন একটা ছবির অংশ হতে পেরে আমি খুবই খুশি।”

ছবিতে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করছেন আনন্দরূপা। নাট্যমঞ্চের পরিচিত অভিনেত্রী এই ছবির হাত ধরে প্রথমবার পা রাখছেন চলচ্চিত্রে। তাঁর কথায়, “আমি সত্যিই ভাগ্যবান প্রথম সুযোগেই ফিরোজা’র মতো একটা চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছি। মাধ্যম হিসেবে প্রথমবার ক্যামেরার মুখোমুখি হ‌ওয়ার কারণে একটু নার্ভাস ছিলাম। এছাড়া কোন‌ও টেনশন ছিল না। অভিজিৎদা যখন আমাকে গল্পটা শুনিয়েছিল এবং চরিত্রটা সম্পর্কে বলল তখন‌ই ভাল লেগেছিল আমার।” নিজের চরিত্র প্রসঙ্গে তাঁর মত, “চরিত্রটায় প্রচুর শেডস রয়েছে। পরে গিয়ে দর্শকরা চমকে যাবেন। তাই আমি চাই দর্শকদের কাছে ফিরোজা চরিত্রটা অজানা থাকুক। সিনেমা দেখার পর তাঁরা চরিত্রটাকে জানুক। ছবিতে আমি যে গল্পটার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছি সেটার সঙ্গে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা যোগাযোগ রয়েছে। সেটা আমার খুব ভাল লেগেছে। কারণ ওঁর আঁকা ‘বিসর্জন’ ছবিটা আমার খুব প্রিয়। তাই ভাল লেগেছে কাজটা করতে পেরে।”

ছবিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে রয়েছেন সুদীপ মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “ছবিতে আমি একজন তদন্তকারী অফিসারের চরিত্রে অভিনয় করেছি। আমার চরিত্রটি মূলত ধ্রুবকে গাইড করে। আনন্দ পেয়েছি কাজটা করে। অনেক আইডিয়ার আদানপ্রদান হয়েছে। ছবিটা কীভাবে হচ্ছে, কী ধরণের ফ্যান্টাসি, কী করার চেষ্টা করছেন পরিচালক সেগুলো জেনেছি। আমি খুব ভাগ্যবান। কারণ নতুন যারা এইরকম অসাধারণ ভাবনাচিন্তা নিয়ে ছবির তৈরি করছেন তাঁদের সঙ্গে কাজ করতে পারছি। আমি সবসময়ই তাই নতুনদের সঙ্গে কাজ করতে ভালবাসি।”

যুধাজিৎ বলেন, “এই ছবির শুটিং আমার কাছে একটা শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা ছিল। কারণ, এই ছবিতে কাজের সুবাদে আমি দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করেছি। উনি এমন একজন মানুষ, যাঁর অভিনয়শৈলী আমি বহুবছর ধরে অনুসরণ করে আসছি। অভিজিৎদার সঙ্গে আমি আগেও কাজ করেছি। তবে এই ছবিতে ঋষভ ও কোরকের সঙ্গে কাজ করাটা একটা আলাদা অনুভুতি এনে দিয়েছিল।”

ছবিতে একটি ছোট্ট তবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছেন দীপক হালদার। “অভিজিতের সঙ্গে আমি আগেও কাজ করেছি। আমার অভিনীত চরিত্রটা আমি না করলেও অন্য যে কেউ করতে পারত। কিন্তু অভিজিৎকে আমি বরাবরই অন্যভাবে দেখি। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে সিনেমা নিয়ে শিক্ষা বিষয়টা খুবই কম জনের মধ্যে রয়েছে। অভিজিৎ একজন শিক্ষিত পরিচালক। খুব নিষ্ঠার সঙ্গে ও কাজ করে। বিষয়বস্তুর যে সীমাবদ্ধতায় বাংলা ছবির আটকে গিয়েছে, সেখান থেকে অভিজিতের এই ছবি একটা নতুন ভাবনার জানালা অন্তত খুলে দিয়েছে। বাঙালির যে শিল্পবোধ, মেধা নিয়ে সিনেমা হতে পারে, আমরা গর্ব করে বলতে পারি এটা বাংলা ছবি, বাঙালির ছবি…তেমন‌ই একটা সিনেমা হল ‘ধ্রুবর আশ্চর্য জীবন’, বলেন অভিনেতা।

Loading


Share It