Film Review: দো-আঁশলা জীবন গাঁথার প্রতিচ্ছবিই ‘দোআঁশ’
সোমনাথ লাহা
পদ্মা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র এই তিন নদীর অববাহিকার ব-দ্বীপ এলাকায় অবস্থিত সুন্দরবন। যেখানে জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘের সঙ্গে মানুষের সহাবস্থান। সাগরের উপকূলবর্তী হওয়ার কারণে এই জায়গার মাটি দো-আঁশলা। বালি-কাদার সংমিশ্রণ রয়েছে তাতে। এহেন জায়গায় জীবনযাত্রার মধ্যেও তাই নোনা জল, নোনা মাটি আর নোনা কান্নার পরত জড়িয়ে থাকে আষ্টেপৃষ্ঠে। সেই সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের জীবনের গল্পই ‘দোআঁশ’। পরিচালক সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম বড়পর্দার ছবি।
ছবির কাহিনি বিন্যাস পরিচালকের নিজের হলেও সেটির বিস্তারের মধ্যে রয়েছে ফাঁকফোকর। তাও সুমিত দামের চিত্রনাট্য সেটিকে টেনে নিয়ে যায়। পর্দায় মূল চরিত্র হিসেবে ধরা দেয় ঝুমরি, তার ঠাকুমা সারথী, দিবাকর এবং ঠিকাদার। এই চারটি চরিত্র যেন সুন্দরবনের জল-হাওয়ায় মিশে থাকা মানুষ। পর্দায় তাই চরিত্রগুলিকে দেখে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।

ছবি শুরু হয় ৫৫ বছর বয়সী আদিবাসী মহিলা সারথীর আত্মকথন দিয়ে। সে এই গল্পের কথক তথা অন্যতম খুঁটি। তার সর্দার স্বামী ও একমাত্র ছেলেকে বাঘে খেয়েছে। কামোটের শিকার পুত্রবধূ। সম্বল বলতে একমাত্র নাতনি ঝুমরি। সেই নাতনিকে সমাজের কুদৃষ্টির হাত থেকে বাঁচিয়ে, সংসারের হাল ধরতে সুন্দরবনের খাঁড়ির জলে ডিঙি চালায় সারথী। দৃঢ়ভাবে দাঁড় টানে বিরুদ্ধ বাতাসকে তুচ্ছ করে। জীবনকে বাজি রেখে লড়াই করে একমাত্র নাতনির জন্য।
আরও পড়ুন: ‘অরণ্য’র প্রাচীন প্রবাদ’ নবীন পরিচালকের কপিবুক স্ট্রেট ড্রাইভ
ঝুমরির মনের মানুষ দিবাকর। সে ঝুমরির জন্য গান বাঁধে। কিন্তু ঘটনাচক্রে তার বাবাকেও বাঘে খায়। সংসারের হাল ধরতে মউলে হয়ে মধু আনতে জঙ্গলে যেতে চায় দিবাকর। কিন্তু জঙ্গলে দখিন রায়ের বিচরণ। তাই দিবাকরের মউলে হওয়া মানতে পারে না ঝুমরি। কিন্তু দিবাকর নৌকা বাইতে পারে না, মাছ ধরার কৌশলও তার অজানা। হাটে সবজি বিক্রি করার টাকাও তার কাছে নেই। তাই বাবার বন্ধু নিমাইয়ের কাছে মধু সংগ্রহের কাজ শিখে মউলে হয়ে জঙ্গলে রওনা দেয়। প্রথমবার ভালভাবে ফিরে এলেও পরের বার মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের খপ্পরে পড়ে দিবাকর। সকলে তাকে খোঁজার দায় ঝেড়ে ফেললেও, মানতে চায় না ঝুমরি। দিবাকরকে খোঁজার জন্য ‘সার্চ পার্টি’ পাঠাতে ঠিকাদারের কাছে অনুনয় করে।

শেষ পর্যন্ত ‘সার্চ পার্টি’ নিয়ে জঙ্গল থেকে দিবাকরকে জীবন্ত উদ্ধার করে আনে ঝুমরি। এর বেশি জানতে হলে দর্শকদের সিনেমাহলে যেতে হবে। কিন্তু ছবি শেষ হতে না হতেই বেশ কিছু প্রশ্ন এবং একইসঙ্গে খটকা মাথায় জট পাকিয়ে বসে। সে বিষয়ে আসছি পরে।
সবার আগে আসি অভিনয় প্রসঙ্গে। ছবিতে সারথী চরিত্রটিকে রীতিমতো রক্ত-মাংসের করে তুলেছেন সঞ্জিতা মুখোপাধ্যায়। চরিত্রটিকে যেন অন্তরে ধারণ করেছেন তিনি। তাঁর হাঁটাচলা, চোখের ভাষা, অভিব্যক্তি সবটুকু দিয়ে চরিত্রটিকে তিনি যে শুধু নিজের করে নিয়েছেন তাই নয়, কিছু সাধারণ দৃশ্যও তাঁর অভিনয়গুণে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছে। পর্দায় দর্শকদের চোখ অচিরেই টেনে নিয়েছেন সঞ্জিতা। একটি দৃশ্যে পিছনে ফিরে তাকানোর চাহনির সঙ্গে ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠা হাসির রেখাই তাঁর প্রতিভার পরিচয় করিয়ে দেয়। একবাক্যে তিনি অনবদ্য। বাংলা ছবিতে তাঁর পথচলা শুরু হয়ে গেল। এতদিন তিনি সুযোগ পাননি কেন সেই প্রশ্নও মনে জাগে!

ঝুমরির চরিত্রে শ্রীতমা দে নিজেকে প্রমাণ করেছেন পর্দায়। আক্ষরিক অর্থেই ঝুমরি হয়ে উঠেছেন অভিনেত্রী। সংলাপ বলা থেকে অভিব্যক্তি, উদাস চোখের চাহনি, বাঘের মুখ থেকে প্রেমিককে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য আকুলতা সব ক্ষেত্রেই শ্রীতমা অনবদ্য। ঠিকাদারের লালসার শিকার হওয়া ঝুমরির চোখের কোণ থেকে নেমে আসা জলের ফোঁটা যেন মন ভাঙা আয়না। তবুও সেখানেই সে দেখতে চায় কাছের মানুষটাকে। সবমিলিয়ে দারুণ শ্রীতমা। দিবাকরের চরিত্রে অনুভব কাঞ্জিলাল যথাযথ। তাঁর চোখের দৃষ্টি যেন গান বাঁধতে জানা উদাস বাউল। সব মিলিয়ে অনুভবও যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন শ্রীতমার সঙ্গে। পর্দায় ঝুমরি-দিবাকরের প্রেম ঠিক যেন ঐ খাঁটি মধুর মতই। দিবাকর যেটি ছড়িয়ে দেয়ে ঝুমরির কপালে আর তা ঝরে পড়ে ঝুমরির চিবুক দিয়ে। দিবাকরের ওষ্ঠ স্পর্শ করে ঝুমরির ওষ্ঠে। পারিজাত প্রধানের গাওয়া “পিরীত ভরা কালা চোখে…”-র সুরমূর্ছনায় ডুব দেয় দর্শক।
আরও পড়ুন: সাগরপারে শুরু, বাংলায় এবার সাতদিন ‘ফ্রাইডে’!
ঠিকাদারের চরিত্রে এই ছবির চমক কিংশুক গঙ্গোপাধ্যায়। ঠান্ডা গলায় সে যেন এক অর্থে লোলুপ শিকারী বাঘ। তাই বাঘে খাওয়া মানুষের ক্ষতিপূরণের টাকা আত্মসাৎ করতে তার বিবেকে বাঁধে না, তেমনই পাওনা আদায়ের জন্য লালসার দাঁত ফোঁটাতেও সে দ্বিধা করে না। স্বল্প সংলাপে নিপুণভাবে দক্ষতার সঙ্গে চরিত্রটিকে মেলে ধরেছেন কিংশুক। এছাড়াও ছোট্ট চরিত্রে পায়েল রায়ও বেশ ভাল। ঝুমরি শ্রীতমার সঙ্গে তাঁর দৃশ্যে দুই অন্তরঙ্গ বন্ধুর বন্ধন, মজা, খুনসুটি খুব সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে।

৭৮ মিনিটের এই ছবির আরেকটি উল্লেখযোগ্য এবং উপভোগ্য বিষয় হল ছবির সঙ্গীত এবং আবহ। ছবির বেশ কিছু দৃশ্যের মাত্রাকে উচ্চতায় নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে ছবির সঙ্গীত এবং সাউন্ড ডিজাইনিং। সুরোদীপ হাজরার সঙ্গীত ও আবহে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে ছবির গান। তা সে ‘হে বনবিবি রে’ হোক বা ‘কাঙালেরও মাতা তুমি’। মাটির গন্ধ লেগে আছে সব গানে। ধ্বনি ছবিটির একটি সম্পদ। অঙ্কিতা নস্করের পোশাক পরিকল্পনা ছবির পটভূমির সঙ্গে যথাযথ।
তবে ‘দোআঁশ’-এর সমস্তকিছুই দারুণ ভাবে বিন্যস্ত? না। আগেই বলেছি, কিছু প্রশ্ন জট পাকিয়ে বসে মাথায়। শুভজিৎ রায়ের সিনেম্যাটোগ্রাফি সুন্দরবনের বনাঞ্চল, খাঁড়ি, জঙ্গলের মধ্যেকার দৃশ্যগুলো চমৎকার ভাবে ধরতে পারলেও রাতের দৃশ্যের আলো সংযোজন, ফোকাসিংয়ে বড় অপরিণততার ছাপ। দৃশ্যগুলির প্রতি আরও যত্নবান হওয়া যেত। অনির্বাণ মাইতির সম্পাদনা যথাযথ হলেও কাহিনি বিন্যাসের খামতিতে কম সময়ের ছবিটিকেও দীর্ঘ মনে হয়। জঙ্গলের মধ্যে দিবাকরকে বাঘে ধরার দৃশ্যটির স্টেজিং ভাল হলেও বাঘের হাতে জখম হওয়া দিবাকরকে ‘সার্চ পার্টি’ খুঁজে পাওয়ার দৃশ্যে দিবাকর রূপে অনুভবের মেকআপ দেখে বোঝার উপায় নেই যে তাকে বাঘে ধরেছিল। হাতে, পায়ে, মুখে আঁচড়ের চিহ্নমাত্র নেই। বাঘ তাকে কেন মারল না সেই প্রশ্নের উত্তর অধরাই রয়ে গিয়েছে। পরবর্তী সময়ে বুকে ব্যান্ডেজ বাঁধা দিবাকরকে দেখে অবাক হতে হয় বৈকি! এমনকি ছবির চৃড়ান্ত ক্লাইম্যাক্সও হঠাৎ করেই চলে আসে। সেটিরও যথাযথ বিল্ড-আপ নেই। খামতিগুলো বড্ড চোখে লাগে। এমনকি ঝুমরি শ্রীতমার স্কিনটোন আরেকটু শ্যামলা হলে ভাল হত। নোনা জল-হাওয়ায় বড় হওয়া মানুষের গায়ের রং যেমন হয়। মেকআপের এই খুঁত চোখে পড়ে।
আরও পড়ুন: বাংলা ছবির নতুন অধ্যায় ‘দেবী চৌধুরানী’র হাত ধরে
তবে সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায়, সুমনা কাঞ্জিলালের প্রযোজনার এই ছবি প্রতিনিয়ত জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে লড়াই করে বেঁচে থাকা উপকূলবর্তী সকল মানুষের কথা খুব সৎভাবে বলেছে। তাই দর্শকদের বলব ‘দোআঁশ’ ছবিটি দেখুন।