সাফল্যের সঙ্গেই শেষ হল ছোট ছবির বড়ো উৎসব

Share It

সোমনাথ লাহা

ছবির দৈর্ঘ্যে ছোট হলেও বিষয়ভাবনা ও বৈচিত্র্যময়তায় আগামীর সম্ভাব্য মহীরুহ। সেই স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবির জন্যই শহর কলকাতার বুকে প্রস্তুত হয়েছিল বড় মঞ্চ, আন্তর্জাতিক কলকাতা শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল (IKSSF)। পায়ে পায়ে পথ হেঁটে পঞ্চম বর্ষে সেই উৎসব।

সম্প্রতি রোটারি সদনে এক জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়েই শেষ হল বোরোলিন নিবেদিত ইভেন্টাইজার আয়োজিত আইকেএস‌এফ‌এফ-র। আক্ষরিক অর্থেই যেটি ছোট ছবির বড়ো উৎসব। এবার ২১ থেকে ২৬ জানুয়ারি, ছ’দিন ধরে প্রায় ৩৫ টি দেশের ২০০ টির‌ও বেশি শর্ট ফিল্ম দেখানো হয়েছে ফেস্টিভ্যালে।

উৎসবের শেষ দিনে বিভিন্ন বিভাগে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। এদিন অভিনেতা, সহ-অভিনেতা, শিশুশিল্পী সহ মোট ৪০টি বিভাগের সেরা কলাকুশলীদের পুরস্কৃত করা হয়। পাশাপাশি বিশেষ সম্মান জানানো হয় সিনেদুনিয়ার নক্ষত্রদের। দেখানো হয় অভিনেতা-গায়ক-পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্যের মিউজিক ভিডিও ‘তোমার আমার গল্প’। এছাড়াও এদিন‌ই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথমবার প্রকাশ্যে এল পরিচালক সুমন মৈত্র-র ছবি ‘অ২’-র টিজার। কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের জন্মশতবর্ষে ও তাঁর কালজয়ী ছবি ‘মেঘে ঢাকা তারা’-কে শ্রদ্ধা জানিয়ে এই পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবিটির নির্মাণ করেছেন পরিচালক। প্রদর্শিত হয় বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা অভিনেতা প্রয়াত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত, মানস বসু পরিচালিত স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি ‘অরোরা বোরিয়ালিস’।

এবছর আন্তর্জাতিক কলকাতা শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড তুলে দেওয়া হল চলচ্চিত্রের অন্যতম কিংবদন্তি পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। এছাড়া সিনেমা আইকন পুরস্কার পান অভিনেত্রী মনামী ঘোষ। জীবন গুহ মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড পান অভিনেত্রী অনুরাধা মুখোপাধ্যায়।

প্রসঙ্গত, এবছর শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি হিসেবে পুরস্কার পেয়েছে দুটি ছবি। ভারতের ‘রঙ্গ’-এর পাশাপাশি চিনের ‘নর্থ’ এই বিভাগে পুরস্কৃত হয়েছে। সেরা বাংলা শর্ট ফিল্মের পুরস্কার নিজের ঝুলিতে পুরেছে ভারতের ‘দ্য রিভার অফ উইশেস’। সেরা এলজিবিটিকিউ ফিল্মের পুরস্কার পেয়েছে ভারতের ‘পিঙ্ক নাইটস’। এছাড়াও তথ্যচিত্র বিভাগে মাধুর্য অলঙ্কার সেরা পরিচালক হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছেন তাঁর ডকুমেন্টারি ‘রেনবো ক্লাসরুমস’-র সৌজন্যে। সেরা লং শর্ট ফিল্মের পুরস্কার পেয়েছে ভারতের ‘পিপল’। সেরা ভারতীয় শর্ট ফিল্মের তকমা পেয়েছে ‘কাশ’। সেরা শিশু অভিনেতা পুরস্কার পেলেন জিহান জিতেন হোদার ‘পিপল’ ছবিটির জন্য।

কমার্শিয়াল বিভাগে সেরা পরিচালকের পুরস্কার পেয়েছেন বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায় ‘অন্তরা এজইজি’-র জন্য। বৌদ্ধায়নের পরিচালনায় তৈরি মিউজিক ভিডিও ‘তোমার আমার গল্প’-তে গান গাওয়ার সুবাদে সেরা গায়কের পুরস্কার পেয়েছেন অভিনেতা-গায়ক অনির্বাণ ভট্টাচার্য। পুরস্কৃত হয়ে তাঁর অভিমত, “গায়ক হিসেবে পুরস্কৃত হলে বিড়ম্বনাই অনুভব করি। তবে ভালও লাগে। কারণ প্রথাগতভাবে গায়ক হ‌ওয়ার কোন‌ও শিক্ষাই আমি নিইনি। আমি মূলত অভিনয় শিক্ষাই নিয়েছি।” পাশাপাশি এই উৎসব প্রসঙ্গে অনির্বাণ বলেন, “ভালবাসা, সততা এবং আবেগ-অনুভূতি কাজের সঙ্গে থাকলেই সাফল্য আসবে। কারণ এমনিতেও ভারতীয় সিনেমার পরিস্থিতি খুব একটা ইতিবাচক নয়, তাই সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে এধরণের উৎসবের আয়োজন দেখা খুবই আনন্দের।”

পঞ্চম বর্ষের আইকেএস‌এফ‌এফ-র সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেলেন রত্না পাঠক শাহ, ‘আ নাইট আফটার ফল’ ছবিতে অভিনয়ের সুবাদে। এছাড়া ‘মাস্তুল’ ছবির জন্য সেরা বাঙালি অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন অমিত সাহা। প্রসঙ্গত এবছরের উৎসবে উল্লেখযোগ্য শর্ট ফিল্মগুলির মধ্যে ছিল সীমা বিশ্বাস অভিনীত ‘মিসেস তেন্ডুলকর’, লিলেট দুবে অভিনীত ‘দ্য লাইম গ্রিন শার্ট’, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় অভিনীত ‘আম আঁটির পাঁচালি’-র মতো ছবি।

প্রসঙ্গত ২১ জানুয়ারি অনলাইন স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক কলকাতা শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সূচনা হয়েছিল। শর্ট ফিল্ম প্রদর্শনের পাশাপাশি ছিল মাস্টার ক্লাস ও সেমিনার। এবারের উৎসবে প্রায় ৮০ টির‌ও বেশি শর্ট ফিল্ম নমিনেশন পেয়েছিল। সেখান থেকেই বাছাই করে উৎসবের শেষ দিনে সেরাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।

এবারের আইকেএস‌এফ‌এফ-র শেষদিনে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কারে সম্মানিত হয়ে পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “অভিনয়ের সুবাদে বরাবরই মানুষের প্রশংসা, ভালবাসা পেয়েছি। কোন‌ও কাজ ভাল হয়েছে বলার সঙ্গে সঙ্গে দর্শকরা মুখে কিছু না বললেও মনে মনে একটা কথা জানিয়ে দেন। সেটা হল ‘আর‌ও ভাল কাজ করতে হবে।’ কারণ আমাকে যে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে সেটা মানুষের ভালবাসা। কন্ডিশনাল ভালবাসা। তাই যতদিন বেঁচে থাকব, অভিনয়ের মাধ্যমে সেই চেষ্টাই করে যাব।”

এবছরের অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক কলকাতা শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের চেয়ারম্যান সৌরভ চক্রবর্তী জানান, “আমি রীতিমতো আপ্লুত। ভাবতেই পারিনি পঞ্চমবর্ষে এসে এভাবে স্বপ্নপূরণ হতে চলেছে। তার সঙ্গে আনন্দ এটাই যে মনের জোরটা পেলাম পরের বছর এই ফেস্টিভ্যালকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারার। একদিন পর থেকেই পরের বছরের যুদ্ধটা শুরু হয়ে যাবে।” ফেস্টিভ্যাল ডিরেক্টর শাশ্বতী গুহ চক্রবর্তীর কথায়, “এবারের ফেস্টিভ্যালে বাইরের ছবিও যেমন পুরস্কৃত হয়েছে, এখানকার ‘রঙ্গ’, ‘কাশ’, ‘প্লিজ রিমেমবার’-এর মতো ছবিও পুরস্কার পেয়েছে। এই শর্ট ফিল্মগুলো খুব ভাল হয়েছে। আমি ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলিকে অনুরোধ করব এই সমস্ত স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিকে উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসুন।”

Loading


Share It