শিল্পী ও শিল্পের চিরায়ত দ্বন্দ্বে সম্পর্কের টানাপোড়েন, হতাশ পরিচালক সুদীপ্ত!
সোমনাথ লাহা
শিল্প নির্মাণ কি সত্যিই সহজ? নাকি শিল্প নামক ব্যাপ্তির সম্মুখীন হলে বাস্তবতা আর কল্পনার তফাতটা অনুভব করা যায়? শৈল্পিক উচ্চতা অর্জন করতে পারাটা যে সত্যিই কঠিন এবং তার জন্য সাধনার প্রয়োজন তা সহজেই অনুধাবন করা যায়। শুধুমাত্র কি বাণিজ্যিক সাফল্যের মধ্যেই শিল্পের সার্থকতা লুকিয়ে রয়েছে? সৃষ্টির আনন্দে নিমগ্ন শিল্পীর প্রকাশভঙ্গির মধ্যে যে তৃপ্তির ছোঁয়া থাকে তাকে কি খর্ব করে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি? শিল্পীর সঙ্গে শিল্পের এই চিরায়ত দ্বন্দ্ব চিরকালীন।
অদ্ভুত এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নই এবার সেলুলয়েডে উঠে আসছে পরিচালক সুদীপ্ত লাহার প্রথম ছবি ‘কারণ গ্রিস আমাদের দেশ না অথবা ব্লু-ব্ল্যাক ও ট্রান্সপারেন্ট হোয়াইট’-এর মধ্যে দিয়ে। আজকের এই সময়ে দাঁড়িয়ে অতি সহজেই মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে ওয়ার্ল্ড সিনেমা সহ বিভিন্ন ধরণের কন্টেন্ট। তখন পর্দায় নতুন কিছু দেখার প্রত্যাশায় প্রহর গোনেন সিনেমাপ্রেমীরা। তাঁদের সেই আক্ষেপ এবার খানিকটা হলেও মেটাতে চলেছেন পরিচালক। নিজের প্রথম ছবিতেই যথেষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন তিনি।
ছবির নামটি ইতিমধ্যেই অনন্যতায় সম্ভবত দীর্ঘতম বাংলা ছবির নাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। দু’ঘন্টার ‘ফিল্ম উইথ ইন আ ফিল্ম’ এই ছবির বেশিরভাগ দৃশ্যই ওয়ান টেকে শুটিং করা হয়েছে। মূলত লং শট ও মাস্টার শটের ব্যবহার করে ছবির শুট করেছেন পরিচালক। এক একটি দৃশ্য ৭-৮ মিনিট, এমনকি ১০ মিনিট পর্যন্ত টানা নিয়েছেন। এখানেই শেষ নয়। ছবিতে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নো-মেকআপে কাজ করিয়েছেন। ছবিটিকে ম্যানিপুলেশন বর্জিত রাখার জন্য ছবিতে গান তথা আবহসংগীতের কোনও রকম ব্যবহার করেননি। মাত্র সাতদিনেই এই ছবির শুটিং শেষ করেছেন। ছবিটি পরিচালকের ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিচ্ছবি হওয়ার কারণেই ছবির মুখ্য চরিত্রের নামও সুদীপ্ত।

সুদীপ্ত লাহার এই ছবি আসলে শিল্পী ও তাঁর শিল্পসত্ত্বার সঙ্গে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধের মধ্যে দিয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েনের চিত্র তুলে ধরেছে। ছবির কাহিনি আবর্তিত হয়েছে একজন চিত্রপরিচালক সুদীপ্তকে কেন্দ্র করে। তাঁর প্রথম ছবি না চলায় সে রীতিমতো হতাশাগ্রস্ত, মানুষ হিসেবেও অসংবেদনশীল। ভাল কাজ করার জন্য কোনও রকম ত্যাগস্বীকার করতে নারাজ সুদীপ্তকে প্রযোজকের মন রাখার জন্য একটি নিম্নমানের থ্রিলার ছবি তৈরি করতে হয়। একদিন নিজের দিদির বাড়িতে ছবির শুটিং চলাকালীন তার সঙ্গে পরিচয় হয় এক চিত্রশিল্পীর। শিল্প নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারা গভীর প্রভাব ফেলে সুদীপ্তর মনে। কারণ এই চিত্রশিল্পীর কোনও ছবি আজ অবধি বিক্রি হওয়া তো দূরের কথা, প্রদর্শিতও হয়নি। ফলে কোথাও গিয়ে সুদীপ্তর ভিতরে থাকা অহংবোধ ধাক্কা খায়। সে তার সিনেমার নায়ক ও প্রযোজকের সাহায্য নিয়ে এই চিত্রশিল্পীর জন্য একটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নেয়। শেষ পর্যন্ত কার স্বপ্নপূরণ হয়? চিত্রশিল্পীর নাকি চিত্রপরিচালকের! সেই উত্তর অবশ্য পাওয়া যাবে ‘‘কারণ গ্রিস আমাদের দেশ না অথবা ব্লু-ব্ল্যাক ও ট্রান্সপারেন্ট হোয়াইট’ ছবিতেই।
ছবির কাস্টিং অনসম্বল। ছবিতে হতাশ চিত্রপরিচালক সুদীপ্তর চরিত্রে অভিনয় করেছেন অনিন্দ্য সেনগুপ্ত। তার দিদির ভূমিকায় রয়েছেন তনুশ্রী চক্রবর্তী। চিত্রশিল্পীর চরিত্রে দেখা যাবে কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়কে। এছাড়াও ছবিতে অনিন্দ্য পরিচালিত ছবির নায়ক ও নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেছেন গৌরব চট্টোপাধ্যায় এবং রাজেশ্বরী পাল। ছবিতে প্রযোজকের চরিত্রে রয়েছেন কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবিতে সুদীপ্তর দিদির গাড়ির চালকের চরিত্রে পার্থসারথি। ছবির কাহিনি, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন পরিচালক স্বয়ং। সিনেমাটোগ্রাফার উত্তরণ দে। সম্পাদনায় অনির্বাণ মাইতি। সাউন্ড ডিজাইনার শিলাজিৎ চক্রবর্তী। শ্রীমা ক্রিয়েশনের ব্যানারে নির্মিত এই ছবির নিবেদক অভিজিৎ নন্দী। ২১ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পেতে চলেছে এই ছবিটি। সম্প্রতি প্রকাশ্যে এল ছবির ট্রেলার।
ছবিতে কাজের প্রসঙ্গে তনুশ্রী বলেন, “আমি অনেকদিন ধরেই এরকম একটা ছবিতে কাজ করতে চাইছিলাম যেখানে আমাকে কোনওরকম মেকআপ করতে হবে না। শুধুমাত্র শুটিংয়ে এসে প্রস্তুতি নিয়ে সেটে ঢুকে পড়ব। তাতে শুটিংয়ের সময়টা বাঁচবে। এখানে সেটা হয়েছে।” তনুশ্রী আরও জানান, “রিয়্যাল লাইফ স্টোরি এটা। সেটা আমাকে খুব আকর্ষণ করেছে। একইসঙ্গে এই ছবির শুটিং করার আইডিয়াটাও। আমার প্রথমে মনে হয়েছিল সুদীপ্ত শুধুমাত্র বলছে, বোধহয় এভাবে ছবিটার শুটিং করবে না। কিন্তু ও পুরোটা এভাবেই করেছে। ছবির শুটিং বাঁধাধরা ছকে না হওয়ায় অন্যরকমভাবে সংলাপ বলার প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। এটা একজন অভিনেত্রী হিসেবে যথেষ্টই চ্যালেঞ্জিং ছিল আমার কাছে।” নিজের চরিত্র সম্পর্কে তনুশ্রী বলেন, “খুবই রক্তমাংসের চরিত্র এটা। মেয়েটি খুব আবেগপ্রবণ। আবার কোথাও গিয়ে আবেগটাকে চেপেও রাখতে পারে। খুব অদ্ভুত, খামখেয়ালি। এই রাগ করছে, কান্নাকাটি করছে। আবার চুপ করে আছে, কখনও হাসছে। খুব লেয়ার্ড একটি চরিত্র। ভীষণ অন্যরকম একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে কাজটা করে।”

পরিচালক প্রসঙ্গে তনুশ্রীর মত, “সুদীপ্ত ভীষণ আত্মপ্রত্যয়ী এবং গোছানো। ও এই চরিত্রে আমাকেই ভেবেছিল এবং আমার সঙ্গেই কাজ করতে চেয়েছিল। আমাকে অনেকদিন ধরে বুঝিয়ে রাজি করিয়েছে এই চরিত্রটা করার জন্য।”
অনিন্দ্যর কথায়, “ সুদীপ্ত ভিস্যুয়ালি যেভাবে গল্পটাকে বলতে চেয়েছে সেটা আমার খুব ভাল লেগেছিল। ছবির চরিত্রেরা ক্রটিপূর্ণ। আমরা বাস্তবে সকলে সেইরকমই। গল্পটার মধ্যে একটা স্তর পর্যন্ত কোনওরকম স্থানচ্যুতি হচ্ছে না। ফলে এই ওঠাপড়ায় এই চরিত্রগুলোর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও একে অপরের ভাবনাচিন্তায় প্রভাব ফেলছে। সেটা বেশ আকর্ষণীয় লেগেছিল। আমরা অভিনেতারা ভীষণ লোভী প্রকৃতির। এটাও লোভনীয় চরিত্র। কতটা করতে পেরেছি জানি না। তবে সুদীপ্তর গল্পটা শুনে আর ওর সঙ্গে কথাবার্তা বলে আমার মনে হয়েছিল ও কি চায় সেটা সম্পর্কে ওর দৃঢ় ধারণা রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে ওর সঙ্গে কাজ করতে ভালই লেগেছে। তাই হ্যাঁ বলতেও সময় লাগেনি।”

ছবির নামকরণ প্রসঙ্গে অনিন্দ্যর অভিমত, “যতবড় নাম, ততটা হওয়ার কথা ছিল না। ‘কারণ গ্রিস আমাদের দেশ না’ অথবা ‘ব্লু-ব্ল্যাক ও ট্রান্সপারেন্ট হোয়াইট’ দুটোর মধ্যে একটাকেই বাছার কথা হয়েছিল। যদিও দুটো নামেরই তাৎপর্য রয়েছে গল্পের সঙ্গে। তারপর সুদীপ্ত আবেগপ্রবণ হয়ে একটা অংশও ফেলতে পারেনি। তাই পুরোটাই রয়েছে।” পাশাপাশি ছবিতে কাজের প্রসঙ্গে অভিনেতা বলেন, “ছবিতে কাজের অভিজ্ঞতা দারুণ। আমার কাজটা করতে গিয়ে মনে হয়েছে একটা জেনারেশন ফিল পাওয়া গিয়েছে। আমি নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে ভাবনায় ছিলাম। লম্বা লম্বা দৃশ্য ছিল। প্র্যাকটিস করে আমরা অভিনয় করেছি।”
ছবির আরেক অভিনেত্রী রাজেশ্বরী জানান,”আমার চরিত্র মূল ছবির সঙ্গে কিভাবে সংযুক্ত হচ্ছে সেটা ছবি দেখলেই বোঝা যাবে। এর বেশি চরিত্রটা নিয়ে এখনই কিছু বলতে চাই না।” ছবির ওয়ান টেক শট প্রসঙ্গে তার মত, “পরিচালক ৭-৮ মিনিট ধরে একটানা এক একটা শট নিয়েছেন এবং যতক্ষণ না তিনি নিজে সন্তুষ্ট হয়েছেন ততবার শট দিতে হয়েছে। বাংলা ছবিতে সেভাবে ওয়ার্কশপ করার সুযোগ নেই। তাই আমরা শট দিতে দিতেই ইমপ্রুভ করেছি।” ছবির নাম প্রসঙ্গে রাজেশ্বরী স্পষ্ট বলেন, “আমি যখন এই নামটা শুনলাম তখন মনে হল একজন বাঙালি পরিচালক তাঁর ছবির নাম এমন রাখছে। আমরা বিদেশেই এইসব জিনিসপত্র দেখে অভ্যস্ত। নামটা শুনে তাই অবাক হয়েছি। নামটা আমার কবিতার মতোই লেগেছিল। মনে হচ্ছিল দেখি ছবির চিত্রনাট্যে কী আছে! চিত্রনাট্যটা পড়ে অসাধারণ লেগেছিল।” তবে মানুষজন এতবড় ছবির নাম আদৌ মনে রাখতে পারবে? উত্তরে অভিনেত্রী বলেন, “মানুষ যতটুকু মনে রাখছে সেটাই আমাদের কাছে অনেক। সবচেয়ে বড় কথা মানুষ এই নামটা আইডেন্টিফাই করেছে। এটা আমি রাস্তাঘাটে দেখেছি, শুনেছিও।”

পরিচালক প্রসঙ্গে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত রাজেশ্বরী জানান, “সুদীপ্ত নতুন হলেও, ওর সিনেমার জ্ঞান কারও চাইতে কম নয়। প্রচন্ড সিরিয়াস, সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা রয়েছে। সাত বছর অপেক্ষা করার পর এই ছবিটা ও বানিয়েছে। ঠিক যেভাবে বানাতে চেয়েছে সেভাবেই বানিয়েছে একার কাঁধে কোনওরকম সাপোর্ট ছাড়াই।”
ছবিতে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করা পার্থসারথির কথায়, “সুদীপ্তর ছবির চিত্রনাট্যটা পড়ে ভাল লেগেছিল। ও ভীষণ পরিস্কার ওর কাজ সম্পর্কে। ও জানে ও কী চায়। কাজটা করে আমার নিজেরও বেশ ভাল লেগেছে।”
ছবি নিয়ে পরিচালক সুদীপ্তর মন্তব্য, “এটা আমার খুব পার্সোনাল ছবি। আমার নিজস্ব কিছু নিরাপত্তাহীনতা অল্প বয়স থেকে কাজ করেছে। আদৌ আমি শিল্পের জন্য দক্ষ কিনা! শিল্প একটা বিরাট বড় বিষয়। চারিপাশে তাকালেই দেখি সবাই শিল্পী। এটা দেখে আমার অস্বস্তি বোধ হয়। কারণ আমার মনে হয়, শিল্পের এই বৃহত্তর উচ্চতায় পৌঁছানোটা খুবই শক্ত। আমরা কেউ হয়ত সেটার ধারেকাছে যেতে পারিনা। বড়জোর চেষ্টা করতে পারি। তাই শিল্পের পথটা ঠিক কী হওয়া উচিত? শিল্প অর্জন করার জন্য সবাই চেষ্টা করছে, এতে আদৌ কিছু হবে! এই সমাজে কি আদৌ শিল্পের প্রয়োজন রয়েছে? এই ধরণের নিরাপত্তাহীনতাগুলো থেকেই এই ছবিটা করেছি।” ছবির নামকরণ নিয়ে পরিচালকের স্পষ্ট মত, “ছবির নামকরণ করার অনেক কারণ থাকে। আমি অনেকরকম দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছি, ভেবেছি বিষয়টি নিয়ে। আমি এই বিষয়ে খুব একটা ব্যখ্যা করতে চাই না। দর্শকরা বরং ছবিটা দেখে ঠিক করুন কেন এই নামকরণ করা হয়েছে। আমি চাই বিভিন্নজন বিভিন্ন রকম দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ছবিটি দেখে বাড়ি ফিরবে। যতগুলো দৃষ্টিকোণ তৈরি হবে ততগুলোই সিনেমা।”

ছবির কাস্টিং নিয়ে পরিচালক বলেন, “একদম যথাযথ কাস্টিং হয়েছে এই ছবির। পরে যখন নিজে ছবিটা দেখেছি তখন বুঝতে পেরেছি। কাস্টিং করার সময় এটা মাথায় কাজ করেনি।” পাশাপাশি কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় ও তনুশ্রী চক্রবর্তীর সঙ্গে কাজ করতে পেরেও রীতিমতো উচ্ছ্বসিত সুদীপ্ত। তাঁর কথায়, “কমলদা অদ্ভুত ভাল মানুষ। সেটে এতটাই সহযোগিতা পেয়েছি কমলদার থেকে যা শেখার মতোই। কিভাবে একজন অভিনেতা নিজেকে প্রস্তুত করে, তাঁর কিভাবে থাকা উচিত এটা কমলদাকে দেখে প্রতিটি অভিনেতা, প্রত্যেকটা মানুষের শেখা উচিত। তনুশ্রীদির সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতাও অদ্ভুত। এত বড় শট ছিল ছবিতে, ওকে দেখে একবারও মনে হয়নি কোথাও এতটুকু অস্থিরতা রয়েছে। প্রত্যেকবারই প্রস্তুতি নিয়ে দীর্ঘ শটগুলো একইরকম ভাবে মনে রেখে দিয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হয় এটা তনুশ্রীদির অভিনয় জীবনের সেরা কাজ। ছবিটা যাঁরা দেখেছেন তাঁরাই এটা বলেছেন।”
ছবিটি মুক্তি পেতে চলেছে আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি।