সরস্বতীর বাহন এবার কলকাতা বইমেলার ম্যাসকট
সোমনাথ লাহা
শীতের কলকাতার অন্যতম আকর্ষণ কলকাতা বইমেলা। ইতিমধ্যেই সেই বইমেলার ঢাকে কাঠি পড়ে গেছে। প্রকাশ্যে এসেছে ৪৮তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলার ফোকাল থিম কান্ট্রি-র নাম, জার্মানি। ২৮ জানুয়ারি মেলা উদ্বোধন করবেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সল্টলেকের করুণাময়ী বইমেলা প্রাঙ্গণে মেলা চলবে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
এবার একটা চমকপ্রদ বিষয় জুড়তে চলেছে আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলার সঙ্গে। এই প্রথমবার পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের তরফে প্রকাশ্যে আনা হল বইমেলার ম্যাসকট। আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলার ম্যাসকট হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে সরস্বতীর বাহন হাঁসকে। তবে সেও একা নয়, রীতিমতো দোকা। ম্যাসকট হিসেবে দেখা যাবে হাঁস দম্পতিকে। চোখে চশমা ও হাতে বই নিয়ে হাসিমুখে বইমেলা প্রাঙ্গণে বইপ্রেমীদের অভ্যর্থনা জানাবে তারা। আনুষ্ঠানিকভাবে বইমেলার ম্যাসকটকে জনসমক্ষে নিয়ে এলেন গিল্ডের সভাপতি ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং সাধারণ সম্পাদক সুধাংশুশেখর দে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কলকাতার জার্মান কনসাল জেনারেল বারবারা ভস এবং কলকাতার গ্যোয়েটে ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর অ্যাস্ট্রিড ভেগে।

এবারের বইমেলাকে একেবারে খোলা আকাশের নীচে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড কর্তৃপক্ষ। এবারের মেলায় কোনও হল না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা। মূলত ইংরাজি বইয়ের প্রকাশকদের জন্যই থাকে হল। এই প্রসঙ্গে গিল্ডের সভাপতি ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় জানান, “২০০৬ পর্যন্ত কলকাতা বইমেলায় কোনও হল ছিল না। বইমেলা ময়দান থেকে মিলনমেলায় যাওয়ার পর সেখানে হল থাকায় ইংরাজি প্রকাশনাগুলিকে সেখানে জায়গা দেওয়া হয়। এরপর করুণাময়ী সেন্ট্রাল পার্কে বইমেলা প্রাঙ্গণ তৈরি করে তাদের জায়গা দেওয়া হলেও সঠিকভাবে বইপ্রেমীদের চোখে না পড়ার কারণে তাদের নানারকম ক্ষোভ, দুঃখ থাকায় এবার আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” প্রসঙ্গত, স্টলের ভাড়াও কমিয়ে দিয়েছে গিল্ড কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও এবারে ইংরাজি প্রকাশনার স্টলের সংখ্যা ১০০ থেকে বাড়িয়ে ১২৫-১৩০টির মতো করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন গিল্ড সভাপতি।
এবছর আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় নারায়ণ সান্যাল, সলিল চৌধুরী, ঋত্বিক ঘটক, তপন সিংহ, অরুন্ধতী দেবীর জন্মশতবর্ষ উদযাপনের পাশাপাশি কাজী নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশের ১২৫ তম জন্মবর্ষ পূর্তির উদযাপনও করা হবে। ৪ ফেব্রুয়ারি বইমেলায় উদযাপিত হবে সিনিয়র সিটিজেন দিবস ‘চিরতরুণ’ এবং মেলার প্রথম রবিবার অর্থাৎ ২ ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হবে ‘শিশু দিবস’।
আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় থাকছে ন’টা গেট। এর মধ্যে একটা জার্মান সাহিত্যিক গ্যোয়েটের নামে এবং আরেকটা জার্মান ভাষাবিদ ম্যাক্স মুলারের নামে। এবারে লিটল ম্যাগাজিন সহ স্টল সংখ্যা গতবারের মতই থাকছে। জায়গার অভাবে স্টল সংখ্যা বাড়ানো যায়নি। এছাড়াও এবার বইমেলায় অ্যাপের সাহায্য নিয়ে যে কোনো স্টল খুঁজে পাওয়ার ব্যবস্থাও থাকবে। খুব শীঘ্রই প্লে-স্টোরে আসতে চলেছে সেই অ্যাপ।

এবারের বইমেলায় ফোকাল থিম কান্ট্রি হিসেবে জার্মানিকে বেছে নেওয়ায় রীতিমতো আপ্লুত কলকাতায় জার্মান কনসাল জেনারেল বারবারা ভস। তাঁর কথায়, “আমরা ভীষণ আনন্দ এবং উৎসাহের সঙ্গে এবারের কলকাতা বইমেলায় অংশগ্রহণ করতে চলেছি। আমরা খুবই আনন্দিত যে আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা কর্তৃপক্ষ জার্মানিকে এবারে ফোকাল থিম কান্ট্রি হিসেবে বেছে নিয়েছেন। নতুন দিল্লির জার্মান দূতাবাস এই বিষয়টিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বইমেলার উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে যেখানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী উপস্থিত থাকবেন সেখানে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে আমাদের তরফে জার্মানির অ্যাম্বাস্যাডর ফিলিপ অ্যাকারম্যান এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। ভারত ও জার্মানির মধ্যে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক যোগসূত্র বহুদিনের। ইন্দো-জার্মান চেম্বার অব কমার্স প্রতিনিয়ত দু’দেশের মধ্যে একটি সুন্দর সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। এবারের বইমেলায় আমরা শিল্প-সাহিত্য-শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রতিদিন আমাদের স্টলে আয়োজন করব। প্রায় ৫০,০০০ ভারতীয় ছাত্র জার্মানিতে পড়াশোনা করছে। আমরা চাই এই সংখ্যা যেন আরও বৃদ্ধি পায়।”
গ্যোয়েটে ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর অ্যাস্ট্রিড ভেগে বলেন, “এবারে আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় জার্মানি তাঁদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরবে। আমাদের স্টলের নকশা তৈরি করেছেন প্রখ্যাত স্থপতি অনুপমা কুন্ডু। যিনি জার্মানি এবং পন্ডিচেরি এই দুই জায়গায় বসবাসের সুবাদে ভারত এবং জার্মানি দু’দেশের মধ্যেকার সেতুবন্ধনের ছোঁয়ার এক অনন্য নিদর্শন রাখতে চলেছেন জার্মান প্যাভিলিয়নে। প্রতিদিন জার্মান প্যাভিলিয়নে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি জার্মান সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির সৃজনশীল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া প্রায় ২০জন জার্মান সাহিত্যিক, কবি এবারের বইমেলায় অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। কলকাতার সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁরা সৃজনশীলতা, নতুন চিন্তাভাবনা সহ বিভিন্ন বিষয়ে মত বিনিময় করবেন।”
তবে বইমেলায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ করা নিয়ে রয়ে গেছে সংশয়ের বাতাবরণ। এই প্রসঙ্গে ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন, “ভারত সরকারের বিদেশ মন্ত্রকের তরফে এই বিষয়ে সদর্থক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে আমাদের কোনও অসুবিধা নেই। তবে সেটা নির্ভর করছে পরিস্থিতির উপর। আগামীদিনে কি পরিস্থিতি থাকবে তার উপর ভিত্তি করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
প্রতি বছরের মত এবারও কলকাতা বইমেলায় অংশগ্রহণ করছে গ্রেট ব্রিটেন, আমেরিকা, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, পেরু, আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া সহ প্রায় ২০টা দেশ।