সপরিবার বিনোদন দিতে আসছে ‘কুট্টুস’

Share It

সোমনাথ লাহা

এক বৃষ্টিস্নাত বিকেল। হাঁটি হাঁটি পা ফেলে চলে বেড়াচ্ছে দু’বছরের এক শিশু। ভবিষ্যতের এক অফুরন্ত সম্ভাবনাকে নিয়ে। নিষ্পাপ, হাসি-খুশিতে মগ্ন এই শিশুটি আসলে ‘কুট্টুস’। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মতিথিতে সেই শৈশবকে সুন্দর এক ভবিষ্যতের উপহার দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ দাদু আশিস সেন ও বাবা অনির্বাণ সেন। সেইজন্য প্রয়োজন সুস্থ রুচিসম্পন্ন বিনোদনের। সেই বিনোদনে গোপনীয়তা কিংবা অন্তরালের বালাই নেই। বরং পরিবারের সকলে মিলে বসে সেই বিনোদনের স্বাদ নেওয়ার পাশাপাশি তার থেকে সুন্দর বার্তাও পেতে পারেন।

এইরকম সুস্থ, রুচিশীল, বাঙালিয়ানায় মোড়া বিনোদনের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়েই পথচলা শুরু করতে চলেছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘কুট্টুস’। যেটির ট্যাগলাইন ‘লুকিয়ে দেখার নয়’। এই ওটিটির নেপথ্যে রয়েছেন আশিস ও অনির্বাণ। তাঁরাই এই ওয়েব প্ল্যাটফর্মের অন্যতম দুই কর্ণধার। প্রসঙ্গত এই প্রথমবার কোন‌ও ওয়েব প্ল্যাটফর্মের নাম একটি দু’বছরের শিশুর নামে রাখা হয়েছে।

এক অর্থে ‘কুট্টুস’ নামটিকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করেছেন এই ওয়েব প্ল্যাটফর্মের নির্মাতারা। কারণ শৈশবের সঙ্গে জুড়ে থাকা পরিচ্ছন্ন, নির্মল, উদ্দীপনা এবং আনন্দময় বিষয় ভাবনার সমাবেশ এই ওটিটি প্ল্যাটফর্মের বিষয়বস্তুর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জুড়ে থাকবে। আপামর বাঙালি দর্শকদের কথা মাথা রেখেই বিষয়বস্তু বাছা হয়েছে।

‘কুট্টুস’-এর মধ্যে রয়েছে দুটি আলাদা বিভাগ। একটি অডিও এবং অপরটি ভিডিও। অডিও বিভাগে রয়েছে কবিতা, গান, শ্রুতিনাটক। ভিডিও বিভাগটিতে রয়েছে কুট্টুস নামের একটি কার্টুন সহ মিউজিক ভিডিও, শর্ট ফিল্ম, ওয়েব সিরিজ, সিনেমা, বিভিন্ন প্রদেশের নৃত্য, ট্র্যাভেল ব্লগ, থিয়েটার, ভিন্নধর্মী সাক্ষাৎকারের মতো বিষয়।

ওয়েব প্ল্যাটফর্মে সাহিত্যনির্ভর কাজগুলি ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য‌ও বদ্ধপরিকর ‘কুট্টুস’। সেইজন্য তাদের কাজের তালিকায় রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশাপাশি মুন্সি প্রেমচন্দের কাহিনি। এমনকি গানের ক্ষেত্রেও বাঙালি মনন থেকে হারিয়ে যাওয়া গানগুলিকেই পুনরায় ফিরিয়ে আনার কাজটাই করতে চলেছে তারা। তাই এখানে রবীন্দ্রনাথের গানের পাশাপাশি শোনা যাবে লালন সাঁই, হাসন রাজা, রাধারমণ দত্ত, শাহ আবদুল করিমের গান।

এখানেই শেষ নয়। পুজোর গান শোনা যাবে কুমার শানুর কন্ঠে। প্রয়াত গীতিকার শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা
ও সুরকার অরূপ-প্রণয় জুটির অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কম্পোজিশনে ‘প্রাণের টানে পুজোর গানে’-র মধ্যে সেই হারানো মেলোডির সন্ধান পাবেন বাঙালি শ্রোতারা।

ইতিমধ্যেই ‘কুট্টুস’-এর বেশকিছু অরিজিন্যাল বিষয়ভাবনা সামনে এসেছে যেগুলি এক কথায় অভিনব। তালিকায় রয়েছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘উপেক্ষিতা’। মনীষ ঘোষ পরিচালিত এই ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন অর্পণ দাস ও পৃথা চট্টোপাধ্যায়। এছাড়া নারী পাচারের মত বিষয় ভাবনা নিয়ে দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত তৈরি করেছেন ‘যাপন’। রয়েছে সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের দায়িত্ববোধ নিয়ে দেবপ্রতিম দাশগুপ্তের শর্ট ফিল্ম ‘পরিণতি’। এছাড়া ‘বিদ্যুৎ শাস্ত্রী’ নামে একটি ছবিও করেছেন পরিচালক। সেখানে পরিচালনার পাশাপাশি অভিনয়‌ও করেছেন তিনি। এছাড়াও আসছে শক্তিপদ রাজগুরুর কাহিনি অবলম্বনে অজয় কুন্ডু পরিচালিত ‘মূল্য’।

আরও আসতে চলেছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মিসমিদের কবচ’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বদনাম’, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘অনুরাধা’ এবং মুন্সি প্রেমচন্দের ‘কফন’ এবং ‘নমক কা দারোগা’-র মত কাজ। এছাড়াও ‘কুট্টুস’-এ দেখা যাবে ৫২ মিনিটের থিয়েটার সহ মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের লেখা অনুনাটক, যেগুলি সিনেম্যাটিক ফর্মে (শর্ট ফিল্ম বা এক ঘন্টার ছবি হিসেবে) দেখা যাবে। এছাড়াও সাধারণ মানুষের কাছে বা আর‌ও ভাল করে বললে ঘরে ঘরে পৌঁছে যাওয়ার জন্য ‘জনতা এক্সপ্রেস’ ও ‘রোজগেরে গিন্নি’-র মত জনপ্রিয় গেম শোয়ের আদলে অনুষ্ঠানের প্ল্যানিং করছেন নির্মাতারা।

মহালয়ার পরদিন অর্থাৎ ৩ অক্টোবর থেকে স্ট্রিমিং শুরু হবে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘কুট্টুস’-র। সাধারণ মানুষের কথা মাথায় রেখে অ্যাপের সাবস্ক্রিপশন মূল্য বছরে ৫০০ টাকার কম রাখার পরিকল্পনা করেছেন ওটিটি-র কর্ণধার আশিস সেন।

‘কুট্টুস’-এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা উপলক্ষে প্রেস ক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব তথা অভিনেতা চন্দন সেন, পরিচালক-অভিনেতা দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত। ছিলেন পরিচালক মনীষ ঘোষ, পরিচালক অজয় কুন্ডু, সঙ্গীত পরিচালক অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় সহ ‘কুট্টুস’-এর সিইও এবং মার্কেটিং ডিরেক্টর আশিস সেন ও অনির্বাণ সেন ও বহু বিশিষ্ট মানুষজন।

আশিস সেন বলেন, “আমরা এপ্রিল মাসে এই ওটিটি প্ল্যাটফর্ম তৈরির পরিকল্পনা করেছিলাম। এমনভাবে আমরা ‘কুট্টুস’-এর কাজগুলোকে সাজিয়েছি যাতে মানুষজন এখানে সবরকমের আনন্দ পান। সাতের দশক থেকে নয়ের দশক পর্যন্ত সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের যে স্বর্ণযুগ ছিল সেটাকেই আমরা এখানে বজায় রাখার চেষ্টা করেছি। তাই অন্য ওয়েব প্ল্যাটফর্মের মত বিষয় ভাবনায় সেক্স, ভায়োলেন্সের উপর মনোনিবেশ করা হয়নি এখানে। সকলে মিলে একসঙ্গে বসে যাতে ‘কুট্টুস’ দেখতে পারেন, সেইভাবেই সাজানো হয়েছে কনটেন্ট।”

অনির্বাণ সেনের মতে, “এটা বাঙালিয়ানায় মোড়া এমন একটি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে কোন‌ও অ্যাডাল্ট কনটেন্ট থাকবে না। আমরা চেষ্টা করেছি ভাল সাহিত্যধর্মী কাজকে আবার মানুষের কাছে ফিরিয়ে আনার। এটা মূলত আমার বাবা আশিস সেনের ব্রেন চাইল্ড। উনি বরাবরই চ্যালেঞ্জ নিতে ভালবাসেন। এমন একটা কিছু করার কথা উনি ভেবেছিলেন। এটা একটা পরিচ্ছন্ন ওটিটি চ্যানেল, যেখানে সমস্ত বিষয় হবে বাঙালিয়ানায় মোড়া। পুরো পরিবারের সকলে মিলে উপভোগ করতে পারবেন। চ্যানেল পাল্টানোর বা বন্ধ করার প্রয়োজন পড়বে না।”

চন্দন সেনের কথায়, “এই ওয়েব প্ল্যাটফর্মে নাটকের দায়িত্বটা আমার। এই বিভাগটিই একটিমাত্র জায়গা যেটি সাত থেকে নয়ের দশকের মধ্যে আবদ্ধ নেই। পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত জেলার ভাল ভাল প্রযোজনাগুলো (৫২মিনিটের থিয়েটার) এখানে দর্শকরা দেখতে পাবেন। অবশ্যই একটু ভাগ ভাগ করে। এছাড়া আমাদের কিছু নিজস্ব ভাবনাও রয়েছে। সেটা কিছু শর্ট ফিল্ম। কারণ আমাদের নাটকের যে উপাদান রয়েছে সেগুলোকে সিনেমায় আনা হলে সাফল্য পাওয়া যায় সেটা দর্শকরা ইতিমধ্যেই দেখেছেন। তাই মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের লেখা অনুনাটকগুলিকে আমরা সিনেম্যাটিক ফর্মে দর্শকদের সামনে আনতে চেষ্টা করছি।”

দেবপ্রতিম দাশগুপ্তর মন্তব্য, “আমি প্রথমদিন থেকেই ‘কুট্টুস’-এর সঙ্গে রয়েছি। নিজস্ব পরীক্ষাধর্মী কাজের পাশাপাশি সাহিত্য নিয়েও কাজ করছি। তার মধ্যে প্রেমচন্দের ‘কফন’ রয়েছে। দর্শকদের প্রতিনিয়তের চাওয়া পাওয়া গুলোকে মিটিয়ে দেবে এই ওয়েব প্ল্যাটফর্ম। এখানে আমি আমার সামর্থ্য ও সীমাবদ্ধতা দুটোর সম্পর্কেই জানি। এটা এমন একটা স্বচ্ছ দরজা যেখানে দুদিক সমানভাবে দেখতে পাচ্ছি। আজকের এই সময়ে দাঁড়িয়ে সাহিত্য নিয়ে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছি কারণ সেই সহযোগিতার হাতটা রয়েছে। আমার বিশ্বাস আমাদের সকলের এই চেষ্টা বিফলে যাবে না। অনেক মানুষের কাছে একটা রিলিফের জায়গা হবে ‘কুট্টুস’।”

মনীষ ঘোষের কথায়, “এটা এমন ধরণের বিনোদন ক্ষেত্র যা দেখতে মানুষ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন। এখানে নাচ, গান, শ্রুতিনাটক যেমন রয়েছে তেমনি সাহিত্যনির্ভর কাজ‌ও রয়েছে। আমি নিজে বিভূতিভূষণের ‘উপেক্ষিতা’ গল্পটি দুটো অধ্যায় শুটিং করেছি। বাংলার পাশাপাশি হিন্দি কাজ‌ও হচ্ছে। আমি মুন্সি প্রেমচন্দের ‘নমক কা দারোগা’ গল্পটি নিয়ে ওয়েব সিরিজ করছি। আমি মনে করি ‘কুট্টুস’ বিনোদনের সমস্ত জায়গা পূরণ করার জন্যই আসছে।”

সঙ্গীত পরিচালক অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “অতীতের যে দিনগুলোকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি সেই ঐতিহ্য, রুচিবোধকে সিনেমা, থিয়েটার, সঙ্গীতের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনাই আমাদের লক্ষ্য। কুমার শানুর গাওয়া গানগুলোর মিউজিক ভিডিও দেখলে এবং শুনলেই সেই পুরোনো মেলোডি, বাঙালিয়ানার ছোঁয়া আপনারা পাবেন। আমার বিশ্বাস শ্রোতাদের মনে দাগ কাটবে গানগুলো।”

ছবি: সোমনাথ লাহা

Loading


Share It