শেখর-ললিতার প্রেম ঘিরে হ‌ইচ‌ই, এবার অদিতির ‘পরিণীতা’

Share It

সোমনাথ লাহা

যুদ্ধ হোক কিংবা বিদ্রোহ, চারিপাশে যত‌ই থাকুক অস্থিরতার ছোঁয়া, তার মধ্যেও বেঁচে থাকে শাশ্বত প্রেম। খাঁটি সোনার মতই আগুনের তপ্ত আঁচে পড়েও তার ঔজ্জ্বল্য এতটুকু মলিন হয়ে যায় না। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় রোম্যান্টিক উপন্যাস ‘পরিণীতা’। অমূল্য সেই আখ্যান জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে শেখর-ললিতার প্রেম গাথা। প্রেম, ত্যাগ এবং পরিণয়ের এই গল্পে শেখর-ললিতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে গিরিন‌ও। ১৯১৪ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাস সেলুলয়েড চিত্রায়নের পাশাপাশি নাট্যমঞ্চেও মঞ্চস্থ হয়েছে বহুবার। শুধু তাই নয়। বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদও করা হয়েছে উপন্যাসটি।

শরৎচন্দ্রের সেই উপন্যাসকেই এবার সিরিজ রূপে ১৯০৫ তথা বঙ্গভঙ্গের গনগনে আঁচে উত্তাল অবিভক্ত বাংলার প্রেক্ষাপটে বুনেছেন পরিচালক অদিতি রায়। জনপ্রিয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হ‌ইচ‌ই-এর ‘বেস্ট অফ বেঙ্গল’ সেগমেন্টের দ্বিতীয় নিবেদন হিসেবে দেখা যাবে ‘পরিণীতা’। সিরিজে উপন্যাসটিকে দশ বছর পিছিয়ে নিয়ে গিয়েছেন পরিচালক। ১৯০৪-১৯০৮ এর অস্থির বাংলার প্রেক্ষাপটে সিরিজের চিত্রনাট্য ও সংলাপ বুনেছেন শর্বরী ঘোষাল। বঙ্গভঙ্গের সময়ের উত্তাল বাংলায় স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ারের পাশাপাশি উঠে এসেছে ক্ষুদিরাম বসুর মৃত্যুর ঘটনাও। প্রেক্ষাপটে রয়েছে দ্বারভাঙা, মুঙ্গেরের উল্লেখ‌ও।

ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে আসা সিরিজের টিজার দেখে দর্শকরা জেনেই গিয়েছেন সিরিজে শেখর ও ললিতার চরিত্রে রূপদান করেছেন গৌরব চক্রবর্তী ও দেবচন্দ্রিমা সিংহ রায়। প্রথম বারের জন্য জুটি বেঁধেছেন দু’জনে। সম্প্রতি শোভাবাজার নাটমন্দিরে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ পেল ‘পরিণীতা’ ট্রেলার। প্রকাশ্যে এলেন বাকি কুশীলবরা। উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র গিরিনের চরিত্রে রয়েছেন অর্পণ ঘোষাল। নাট্যমঞ্চ, ছোটপর্দা এবং ওয়েব আঙিনার পরিচিত মুখ অর্পণ সম্প্রতি পা রেখেছেন বড়পর্দাতেও। ললিতার মামা গুরুচরণের ভূমিকায় রয়েছেন দেবদূত ঘোষ। শেখরের পিতা নবীন রায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন লোকনাথ দে। শেখরের মা ভুবনেশ্বরী দেবীর চরিত্রে রয়েছেন পুষ্পিতা মুখোপাধ্যায়। এছাড়াও উপন্যাসে সেভাবে উল্লিখিত নয়, এমন একটি চরিত্রের সংযোজন ঘটিয়েছেন পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার। শেখরের বৌদি লবঙ্গ চরিত্রে দেখা যাবে মিমি দত্তকে।

সিরিজে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত। সিনেমাটোগ্রাফার রম্যদীপ সাহা। সম্পাদনায় শুভজিৎ সিংহ। শিল্প নির্দেশনায় তন্ময় চক্রবর্তী। ট্রেলার লঞ্চে নিজেদের অভিজ্ঞতার বিষয়টি সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন কলাকুশলীরা।

সিরিজের বিষয় ও নিজের অভিনীত চরিত্র নিয়ে যথেষ্ট‌ই খোলামেলাভাবে মতামত জানালেন গৌরব। অভিনেতা বলেন, “আমরা সকলে মিলে চেষ্টা করেছি দর্শকদের দারুণ কিছু উপহার দেওয়ার। পাশাপাশি এটাও মাথায় রাখতে হয়েছে গল্পের মান যেন অক্ষুন্ন থাকে। এই ‘পরিণীতা’ দেখে দর্শকরা যেন মনঃক্ষুণ্ন না হন। একেবারে ব‌ইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা গল্পকেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি আমরা। আমাদের লক্ষ্য একটা নতুন প্রজন্মের কাছে নতুন ভাবে এই কাহিনিকে পৌঁছে দেওয়া।”

নিজের চরিত্র নিয়ে তার মন্তব্য, “এই চরিত্রে অভিনয় করার সময় একটা দায়িত্ববোধ কাজ করেছিল। আমার আগে যাঁরা এই কাজটা করেছেন তাঁদের মান যেন রাখতে পারি। দর্শকদের কাছে এক‌ইভাবে পৌঁছে যেতে পারি। তবে দায়িত্ববোধের বিষয়টা নিয়ে বেশি ভাবিনি কারণ সেটা কাজে ছাপ ফেলতে পারে। সেই কারণেই নতুন করে তাঁদের কাজগুলো দেখিনি। বরং ব‌ইটা পড়ার পাশাপাশি শর্বরীদির লেখা চিত্রনাট্য বারংবার পড়ে যতটা সম্ভব নিষ্ঠা দিয়ে শেখর চরিত্রটিকে পর্দায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।” তবে এই চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে পরিচালক ও চিত্রনাট্যকারের পরামর্শ মেনে সেই সময়ের মানুষের হাঁটাচলা, কথাবার্তা রপ্ত করেছেন গৌরব।

উপন্যাসটিকে বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে নির্মিত করার বিষয়ে অভিনেতা বলেন, “এটা সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে করা হয়েছে। কারণ ঐ সময়ের বিষয়টি ব‌ইয়ে পড়া একরকম কিন্তু পর্দায় এগুলোই কাজটাকে সমৃদ্ধ করে।” পাশাপাশি এই কাজের সূত্র ধরে ঐ সময়ে টাইম ট্র্যাভেল করতে পেরে শিহরিত গৌরব। তার কথায়, “আমার নিজের ওই সময়কার বাংলা, ইতিহাস-সাহিত্য নিয়ে আকর্ষণ রয়েছে। পড়তেও ভাল লাগে।”

পরিচালকের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অভিনেতার স্পষ্ট মত, “অদিতিদির সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা দারুণ। আমাদের দশ বছরের পরিচয়। আমি যখন ব্যোমকেশ করেছি তার সৃজনশীল পরিচালক ছিলেন অদিতিদি। তাই আমাদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়াটা খুব ভাল। কোন‌ও কিছু মনে হলে একে অপরকে নির্দ্বিধায় বলতে পারি।”

দুই সহ অভিনেতা দেবচন্দ্রিমা ও অর্পণের সঙ্গে কাজ করেও উচ্ছ্বসিত গৌরব। তাঁর কথায়, “দু’জনের সঙ্গেই আমি প্রথমবার কাজ করলাম। খুব ভাল লেগেছে। দেবচন্দ্রিমা ‘ললিতা’ চরিত্রের জন্য অদিতিদি ও শর্বরীদির পরামর্শ নিয়ে প্রচুর খেটেছে, পড়াশোনা করেছে। ওর কাজের প্রতি নিষ্ঠা দেখে আমার ভাল লেগেছে।” অপরদিকে অভিনেতা বলেন, “আমি অর্পণের কাজের খুব ভক্ত। নটধা-র ‘মহাভারত’ নাটকে ওর কৃষ্ণের চরিত্রে অভিনয় দেখে আমি নিজে ওর সঙ্গে আলাপ করেছিলাম। যখন জানতে পারলাম গিরিনের চরিত্রে অর্পণ অভিনয় করছে তখন মনে হল এই কাজের মানটা আর‌ও কয়েকগুণ বেড়ে গেল। চরিত্রটা ও খুব ভাল ফুটিয়ে তুলেছে।” তবে ‘পরিণীতা’র সঙ্গে তাঁর পারিবারিক সম্পর্ক নিয়ে গৌরবের সহাস্য উত্তর, “বাবা (সব্যসাচী চক্রবর্তী) নবীন রায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আমি শেখরের চরিত্রে অভিনয় করছি। দুই ‘পরিণীতা’-র যোগসূত্র আমি।” পাশাপাশি এটা জানাতেও ভুললেন না যে তাকে শেখর রায়ের চরিত্রে দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে রয়েছে স্ত্রী ঋদ্ধিমাও।

কাজের সূত্রে মুম্বইয়ে থাকা দেবচন্দ্রিমা ভিডিও বার্তায় বলেন,”আমি ভীষণভাবে উচ্ছ্বসিত এবং আনন্দিত যে প্রথমবার কোন‌ও পিরিয়ড পিসে কাজ করতে গিয়ে এরকম একটা আইকনিক চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছি। আমি পরিচালক ও নির্মাতাদের ধন্যবাদ জানাই এই ধরণের একটি চরিত্রে আমাকে কাজের সুযোগ দেওয়ার জন্য। আশাকরি দর্শকদের আমাকে ‘ললিতা’ রূপে পছন্দ হবে।”

দেবদূতের কথায়, “সাহিত্যধর্মী কাজ আমি আগাগোড়া করে এসেছি। দর্শকরা বিভিন্ন সময়ে আমাকে সাহিত্যের চরিত্রে দেখেছেন। এই ধরণের গল্পে চরিত্রের পুরোটা জানা থাকায় কাজ করতে সুবিধা হয়। এখানে আমি ললিতার মামা গুরুচরণের চরিত্রে রয়েছি। সে স‌ওদাগরী আপিসে সামান্য বেতনের কেরানি। টানোপড়েনের সংসার। তিনি চান ললিতার সুপাত্রে বিয়ে হোক। তবে তাঁর জন্য‌ই ললিতা ও শেখরের মধ্যে ভুল বোঝা তৈরি হয়। চেষ্টা করেছি চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তোলার।”

লোকনাথের মতে, “রবীন্দ্রনাথ-বঙ্কিমচন্দ্র-শরৎচন্দ্রের লেখা নিয়ে কাজ করতে গেলে এখনও অভিনেতা হিসেবে একটা শিহরণ হয়। শরৎচন্দ্রের চরিত্রগুলোকে কাছের মানুষ বলেই মনে হয়। সেই কারণেই আপামর বাঙালির সঙ্গে চরিত্রগুলো অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকে। ‘পরিণীতা’ সেরকম এক কালজয়ী উপন্যাস। আমার চরিত্র নবীন রায়ে সিরিজে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রয়েছে। চরিত্রটা ধূসর এবং কৌশলী। একজন অভিনেতা হিসেবে ঐ সময়ের একজন ব্যবসায়ী জমিদারের চরিত্র যতটা সম্ভব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।”

পুষ্পিতার কথায়, “প্রথমে যখন জানতে পারলাম শেখরের মা ভুবনেশ্বরীর চরিত্রে আমাকে নেওয়া হয়েছে ভীষণ আনন্দ হয়েছিল। খুব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। এই চরিত্রের দুটি অধ্যায় রয়েছে। একটি সধবা এবং অপরটি যখন শেখরের পিতৃ বিয়োগ হয়। ললিতার প্রতি তার অপত্য স্নেহ রয়েছে। তার সঙ্গে শেখরের বিয়ে হোক এটা তিনি শেষ দিন পর্যন্ত চেয়েছেন। অদিতি আমাকে এই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য স্বাধীনতা দেওয়ার পাশাপাশি ছোট ছোট অনেক বিষয়ে সাহায্য করেছে যেটা আমার অভিনয়শৈলীকে অনেকটাই সাহায্য করেছে।”

মিমির মতে, “কি বলব বুঝতেই পারছি না। এই উপন্যাসে ‘লবঙ্গ’ বলে কোন‌ও চরিত্র ছিল না। তাই আমিও অবাক হয়েছিলাম। এটা চিত্রনাট্যকার শর্বরীদি ও পরিচালক অদিতি রায়ের সংযোজিত একটা চরিত্র। লবঙ্গ শেখরের বৌদি কিন্তু সমবয়সী হ‌ওয়ায় একে অপরের সঙ্গে মিষ্টি সম্পর্ক রয়েছে। এই চরিত্রটি হচ্ছে শেখরের আস্থা, বিশ্বাসের জায়গা, পথপ্রদর্শক সবকিছু। ললিতা ও শেখরের প্রেমের সাক্ষী সে। দর্শকদের আশা করি খুব ভাল লাগবে।”

নতুন করে ‘পরিণীতা’ পরিচালনা করা প্রসঙ্গে অদিতি রায় বলেন, “আমি নিজেই এই নির্মাণের দায়িত্ব নিয়েছি। কারণ পিরিয়ড ড্রামা নিয়ে কাজ করতে আমার ভাল লাগে। এর আগে টেলিভিশনে পিরিয়ড ড্রামায় সৃজনশীল পরিচালক হিসেবে কাজ করেছি। এটা আমার প্রথম পরিচালিত পিরিয়ড ড্রামা। এটা আমার তৈরি ‘পরিণীতা’ তাই আমার মতন করে বলা। সেটা দর্শকরা দেখলেই বুঝতে পারবেন। বঙ্গভঙ্গের সময় যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল সেটাকে প্রেক্ষাপটে রেখেই এই প্রেমের গল্পটা বলার চেষ্টা করেছি। শরৎচন্দ্রের লেখা মূল উপন্যাসের কাঠামো অক্ষুন্ন রেখেই লেখা হয়েছে চিত্রনাট্য।” পাশাপাশি পরিচালক আর‌ও বলেন, “ঐ সময়ের প্রেক্ষিতে ইতিহাস যতটুকু ছুঁয়ে দেখা সম্ভব, সেটাই চেষ্টা করেছি। খুব যত্নে তৈরি করেছি। আশা করি ‘পরিণীতা’ নিয়ে যে পরিশ্রম আমি আর আমার টিম করেছি সেটা দর্শকদের আবেগের জায়গাটা ছুঁতে পারবে।”

সব মিলিয়ে আর‌ও একবার ‘পরিণীতা’কে দেখার জন্য যে উৎসুক হবেন দর্শকরা সেকথা বলাই যায়। ১৫ অগাস্ট, স্বাধীনতা দিবসে হ‌ইচ‌ইতে মুক্তি পাবে সিরিজটি।

Loading


Share It