প্রেমদিবসে ভালবাসার চড়াই-উতরাইয়ের গল্প নিয়ে প্রসূনের ‘আমার মন চায়’
সোমনাথ লাহা
ভালবাসার পথ সবসময় মসৃণ হয় না। ভালবাসার মধ্যেও থাকে চড়াই-উতরাই। অনেক কথা, চাওয়া-পাওয়া, রাত জেগে দেখা স্বপ্নের পরেও পরিণতি পায় না বহু ভালবাসা। নিজেদের অলীক সুখের কারণেই তা নিমজ্জিত হয় অতল জলে। তবুও ভাল লাগা থেকে ভালবাসার এই পথ চলা এবং বিচ্ছেদ বেদনা রয়ে যায় জীবনের জমানো অতীতের খাতায়। ভুলতে চাইলেও ভোলা যায় না। সবকিছু পেলেও কি আদৌ পাওয়া যায় সুখ আর শান্তি? অতীত যদি আবার ফিরে আসে! কড়া নাড়ে মনের দরজায়, তবে কি ক্ষমাহীন ভুলগুলোকে গ্রহণ করে আরও একবার নতুনভাবে পথ চলা যায়?
এতদূর পড়ে পাঠক ভাবতেই পারেন ভালবাসার এমন টানাপোড়েনের প্রতিচ্ছবি নিয়ে কেন কথা বলছি। এবার প্রেমদিবসে এমনই ভালবাসার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠলে প্রসূন গাইনের রোম্যান্টিক মিউজিক্যাল শর্ট ‘আমার মন চায়’-তে। প্রসূন গাইন ইনিশিয়েটিভের ব্যানারে নির্মিত এই ফিউশন র্যাপের মিউজিক ভিডিওর মধ্যে দিয়ে ভালবাসার একটি নিটোল গল্প বুনেছেন প্রসূন।
টলিউডে বড়পর্দা ও ছোটপর্দার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিচিত মুখ প্রসূন। তাঁর নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা ইতিপূর্বে বেশ কয়েকটি মিউজিক্যাল শর্টসের পাশাপাশি লার্জ শর্ট ফিল্মের নির্মাণ করেছে। এবারেও এই মিউজিক্যাল শর্টটির ভাবনা ও পরিচালনা করেছেন প্রসূন স্বয়ং।
গতানুগতিক মিউজিক ভিডিওর থেকে আলাদা পথে হেঁটে বরাবর গানকে নিয়ে একটা গল্পের রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন প্রসূন। সেটাই তার নিজস্ব সিগনেচার স্টাইল হিসেবে পরিণত হয়েছে। রোম্যান্টিক এই মিউজিক্যাল শর্ট ‘আমার মন চায়’ তার ব্যতিক্রম নয়। এই কাজের মধ্যে দিয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন মুখ লঞ্চের কাজটিও সারলেন প্রসূন।
এই শর্টের হাত ধরে প্রথমবার পর্দায় অভিনেত্রী দীপর্ণা দাস। পেশায় নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার দীপর্ণা। এখানেই শেষ নয়। এই মিউজিক ভিডিওর হাত ধরেই একজোড়া নতুন সাংগীতিক প্রতিভার আত্মপ্রকাশ ঘটল। শুভজিৎ রাউত ও সৌরভ দে। গানটি লেখার পাশাপাশি গেয়েছেন যথাক্রমে শুভজিৎ ও সৌরভ। মিউজিক কম্পোজ করেছেন সৌরভ দে। শুভজিৎ চক্রবর্তী নিবেদিত এই মিউজিক্যাল শর্টের সিনেমাটোগ্রাফার পবিত্র দাস ও বিনোদ কুমার গৌতম। সম্পাদনায় নীলকান্ত দাস।
‘আমার মন চায়’ প্রজ্ঞা ও অঙ্কনের ভাল লাগা থেকে ভালবাসা, বিচ্ছেদ বেদনা, টানাপোড়েনের প্রতিচ্ছবি। প্রজ্ঞার চরিত্রে দীপর্ণা আর অঙ্কনের ভূমিকায় প্রসূন। কলকাতার পাশাপাশি হালিশহর, কল্যাণী, কাঁচড়াপাড়া, নৈহাটি, শিবদাসপুর সহ ৮-৯টি লোকেশনে হয়েছে শুটিং। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন’স ডে’র দিনেই প্রসূন গাইন ইনিশিয়েটিভের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে মুক্তি পেল শর্টটি।
প্রসঙ্গত, শর্টের লুক ও কস্টিউমের দায়িত্ব সামলেছেন পিয়ালী দাস। সম্পর্কে যিনি প্রসূনের স্ত্রী। পাশাপাশি পিয়ালীর সংস্থা গ্রুম ইয়োরসেল্ফ অডিশনের মাধ্যমেই বেছে নিয়েছে দীপর্ণাকে। সম্প্রতি শর্টের আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় উপস্থিত ছিলেন পরিচালক শিলাদিত্য মৌলিক, গায়ক তিমির বিশ্বাস, অভিনেতা-লেখক তথা কাস্টিং ডিরেক্টর মোমো এম ডি, অভিনেতা পার্থসারথি ও আর্য দাশগুপ্ত।

প্রসূন জানান, “ভালবাসার মধ্যে অনেক চড়াই-উতরাই রয়েছে। প্রতিটি মানুষের জীবনে যেমন থাকে। কারণ, ভালবাসার পথ সবসময় মসৃণ নয়। জীবনে ওঠা-পড়া, দুঃখ আঘাত থাকবে, কিন্তু তার মধ্যেও প্রবাহমান সময়ের সঙ্গে জীবনটাকে এগিয়ে নিয়ে চলাই মূল ভাবনা এই মিউজিক্যাল শর্টের।” বিষয়ভাবনার প্রসঙ্গে অভিনেতা বলেন, “আমি এই গানটা আড়াই-তিন বছর আগে শুনেছিলাম। গানটা শুনেই আমার মাথায় অন্যরকম অনেক ভাবনা এসেছিল। কিন্তু ঠিক এই ভাবনাটা ছিল না। তারপর যখন শুভজিৎ আমাকে এই কাজটা করার পুরোপুরি ছাড় দিল তখন মূল যে ভাবনাটা ছিল সেটা থেকে বেরিয়ে এলাম। কারণ প্রোডাকশন ভ্যালু, জায়গাগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অবশেষে আমি সেই বিষয় ভাবনা নিয়েই কাজটা করেছি যেটাকে আমি যথাযথভাবে সুবিচার করতে পারব।”
নতুন মিউজিক কম্পোজার-গীতিকার সম্পর্কে প্রসূনের অভিমত, “আমি হালিশহরের ছেলে, সৌরভ-শুভজিৎ দু’জনেই ওখানকার। লকডাউনের সময় আমি এই গানটা শুনেছিলাম। তখন আমি ঠিক করেছিলাম নতুন কিছু করলে এদের নিয়ে করব। আমি চেয়েছিলাম আমার সংস্থার মাধ্যমে নতুনদের নিয়ে কাজ করতে। এই কাজটা করার সময় ওদের কথা মাথায় আসায় পুরোটা দুয়ে দুয়ে চার হয়ে গেল।” দীপর্ণার নির্বাচন প্রসঙ্গে অভিনেতা জানান, “গ্রুম ইয়োরসেল্ফের সূত্র ধরেই দীপর্ণাকে কাস্টিং করেছি। তবে মূল কাজটা করেছে আমার স্ত্রী পিয়ালী। ওকে আমি বলেছিলাম আমি এই কাজটার জন্য নতুন মুখের সন্ধানে রয়েছি। পিয়ালী তখন ওর সংস্থার মাধ্যমে দীপর্ণাকে খুঁজে নিয়ে আসে।”
গানটি নিয়ে প্রসূন বলেন, “আমাদের প্রযোজনা সংস্থা সবসময় সফট গান, দুঃখের গান নিয়ে কাজ করে এসেছে। এবার আমরা সেটা ভেঙে ফিউশন র্যাপ নিয়ে কাজ করলাম। আমি বরাবরই যেকোনো গানের সঙ্গে একটা গল্প বলার চেষ্টা করি। সেটা একাধারে চ্যালেঞ্জিং আবার পরীক্ষামূলকও হয়। এবারেও সেটাই করেছি।”
প্রথমবার অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে উচ্ছ্বসিত দীপর্ণা জানান, “অভিনয় শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রসূনদাই আমার প্রথম মেন্টর। তাই প্রথমেই প্রসূনদাকে ধন্যবাদ জানাই। আমি পেশাগতভাবে নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার। অভিনয় কখনও করিনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার ছবির দেখার পর পিয়ালীদির সংস্থা গ্রুম ইয়োরসেল্ফ আমাকে নির্বাচিত করে। তারপর অডিশনের মাধ্যমে ৮০ জনের মধ্যে থেকে আমাকে বেছে নেওয়া হয়। প্রথমে নবাগতা হিসেবে মুখ্য চরিত্রে সুযোগ পেয়ে নার্ভাস ছিলাম। প্রসূনদাকে দেখে ভয়ও লেগেছিল। ভেবেছিলাম বকবে। কিন্তু প্রসূনদা ও পিয়ালীদি এতটাই মসৃণভাবে কাজটা করেছে আর আমাকে আত্মবিশ্বাস দিয়েছে যে ভয়টাই কেটে গিয়েছিল।”

অভিনয় বিষয়ে দীপর্ণার মন্তব্য, “আমি যেহেতু নৃত্যশিল্পী আর মিউজিক ভিডিও অনেকখানিই বিট নির্ভর, তাই প্রসূনদা আমাকে সেভাবেই বলেছে। কোন বিটে কী এক্সপ্রেশন দিতে হবে সেটা প্রসূনদা এত সুন্দর করে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে কাজ করতে এতটুকু অসুবিধা হয়নি।” প্রথমবার নিজেকে অনস্ক্রিনে দেখে উৎসাহিত দীপর্ণা বলেন, “এটা আমার কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। কারণ আমি যদি এমন ডেবিউ করতে পারি, আগামীদিনে সকলের আশীর্বাদ ও সহযোগিতা পেলে আরও ভাল ও বড় কাজ করতে পারব বলেই আমি মনে করি।”
শুভজিৎ এবং সৌরভও বেশ উচ্ছ্বসিত কাজটি করতে পেরে। শুভজিতের কথায়, “প্রসূনদাকে আমি অভিনেতা হিসেবেই চিনতাম। লকডাউনের সময় হালিশহরে ইয়ার্ডের মাঠে আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে দাদা এই গানটা শুনেছিল। তারপর দাদা জানতে চায় গানটা কে গেয়েছে? সেখান থেকেই দাদা আমার কাছে এই গানের স্ক্র্যাচ শুনে বলে আমি এই গানটায় কাজ করব। সেটা যখনই হোক, করব। সাড়ে তিন বছর পর প্রসূনদা ফোন করে বলে চল এই গানটা নিয়ে কাজটা করি। ‘আমার মন চায়’ নামটাও প্রসূনদার দেওয়া। গানটা দাদা এত সুন্দর করে ভিস্যুয়ালাইজ করেছেন, আশাকরি প্রত্যেকের ভাল লাগবে।”
সৌরভের কথায়, “কাজটা করার জন্য প্রসূনদা আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। পাশাপাশি আমাদের সবরকম ভাবে গাইডও করেছে। এখন যেভাবে সবাই গানটা শুনছেন এর লিরিক্স ছাড়া অ্যারেঞ্জমেন্টে অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। আমরা দুজনে মিলে দাদার সহযোগিতায় নতুন কিছু করার চেষ্টা করেছি। এই ২-৩ মাসের জার্নিতে আমার আর শুভর সঙ্গে প্রসূনদা আগাগোড়া ছিল। প্রসূনদা আমাদের গানটাকে যথাযথ পূর্ণতা দিয়েছে। এর চেয়ে ভাল পরিণতি এই গানটা পেত না প্রসূনদা না থাকলে।”
পিয়ালীর মতে, “এই মিউজিক্যাল শর্টটা আমাদের দুজনের দুজনকে দেওয়া উপহার। বিয়ের পর এই প্রথমবার আমরা যৌথভাবে কাজ করলাম। এই কাজটা আমাদের কাছে সন্তানসম। তাই উপহারের থেকেও অনেক বড় কিছু। আমার সংস্থা গ্রুম ইয়োরসেল্ফ অনেকবছর ধরেই গ্ল্যামার দুনিয়ায় ক্যামেরার পিছনে ও সামনে নতুনদের নিয়ে আসছে। প্রসূন আমাকে যখন বলে এমন একটা নতুন মুখ খুৃঁজে দেওয়ার জন্য যে ভাল নাচতে পারে, তাকে হাসলে, এমনকি কাঁদলেও স্ক্রিনে ভাল দেখতে লাগবে। তখন সেই চ্যালেঞ্জটা নিলাম। কলকাতার বিভিন্ন নাচের স্কুল, অ্যাকাডেমিতে গিয়ে অডিশন নিয়েছি। শেষপর্যন্ত ৫০ থেকে ৮০ টার মতো অডিশন নেওয়ার পর দীপর্ণাকে পেয়েছি। তবে আরেকটু সময় পেলে আরও ভাল গ্রুম করতে পারতাম। যতটুকু পেরেছি তাতেই ও যা পারফর্ম করেছে, লোকজনের এক্সপ্রেশন দেখে বুঝতে পারছি সকলের খুব ভাল লাগছে।”

নিবেদক শুভজিৎ চক্রবর্তী বলেন, “প্রসূনদার সঙ্গে আমার পরিচয় পাঁচ বছর আগে। মাত্র ২০মিনিটের আলাপেই যে দাদা-ভাইয়ের সম্পর্কটা তৈরি হয়েছিল সেই সম্পর্ক ধরেই দাদার কাছে আবদার করেছিলাম। প্রসূনদা সেটা এত সুন্দর করে রেখেছে তার জন্য দাদাকে ও তাঁর পুরো টিমকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।”
প্রসূনের এই শর্ট নিয়ে রীতিমতো আনন্দিত গায়ক তিমির বিশ্বাস বলেন, “এখন এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে ফিল্ম ছাড়া মিউজিক বুঝি না। কিন্তু ফিল্মের বাইরেও মিউজিকের একটা জায়গা রয়েছে। তাই ইন্ডিপেন্ডেন্ট মিউজিক নিয়ে আমাদের লড়াই চলছে এবং সেটাকে নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছি। আমার ভাল লাগছে ইন্ডিপেন্ডেন্ট মিউজিকের সমর্থনে যাঁরা অর্থ খরচ করে এরকম একটা কাজ করেছেন তাঁদের পাশে দাঁড়াতে পেরে।”
শিলাদিত্য মৌলিকের কথায়,”প্রসূন যে কাজটাই করে ভাল করে করে। ওর অনেকগুলো মিউজিক্যাল শর্ট আমি দেখেছি। আমাদের কাজই মানুষকে বিনোদন দেওয়া। বিনোদন দুনিয়ায় প্রসূনের অবদান প্রশংসনীয়।”
পার্থসারথির মন্তব্য, “প্রসূন আমার বহুদিনের বন্ধু। আমার এই বন্ধু একটা নতুন উদ্যোগ নিয়েছে। সে নতুন যারা কাজকর্ম করছে তাদের সামনে নিয়ে আসছে। এরকম মহৎ কাজে আমি ওঁর সঙ্গে ছিলাম, আছি আর থাকব। ও যখন ডাকবে তখনই আসব। প্রসূন যে কাজ করবে তাতেই আমি ওঁর পাশে আছি।”
আর্যর কথায়, “প্রসূনদার সঙ্গে আমার অনেক বছরের সম্পর্ক। অনেককিছুই শিখেছি। প্রসূনদার ইনিশিয়েটিভ পথচলা শুরু করেছে। আশাকরি আগামীদিনে দাদা আরও অনেক কাজ করবে। আর আমাকেও প্রসূনদার ইনিশিয়েটিভের কাজে দেখতে পাবেন।”