বয়সের সাথে সাথে মৃত্যু ভাবনাও বদলে যায়: রাহুল

Share It

অতনু রায়

বাংলা ছবির অন্যধারার অভিনেতাদের মধ্যে অন্যতম রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায় এক একান্ত আড্ডায়।

প্রশ্ন: শিল্পী রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ‘মৃত্যু’ কথাটার সংজ্ঞা কি?

রাহুল: প্রচন্ড প্রয়োজনীয় একটা বোধ, যেটা কখনো ছেড়ে যাওয়া উচিত নয় একজন শিল্পীকে। মৃত্যু এমন একটা সত্যি, এমন একটা বোধ যেটা সবসময় স্পর্শ করে থাকে। অন্তত আমার তো তাই বিশ্বাস। একজন শিল্পী মৃত্যুকে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে থাকতে পারেন না। মৃত্যু তাঁর চেতনায় কোথাও একটা গিয়ে সবসময় থেকে যায়।

প্রশ্ন: একজন সাধারণ মানুষ আর একজন শিল্পীর মৃত্যু ভাবনা কি সবসময় আলাদা হয়?

রাহুল: আমি জানিনা। শিল্পীরা সাধারণ মানুষ নন কেন সেটাও আমি জানি না। শিল্পীরাও সাধারণ মানুষ। তবে হ্যাঁ, মৃত্যু নিয়ে রোম্যান্টিসিজম্ আছে, ভয় আছে এবং প্রয়োজনীয় অনুভূতিগুলো যা যা থাকা দরকার সেগুলো আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই আছে। রবি ঠাকুর তো শিল্পোত্তম, তিনি একটা বয়সে বলেছেন “মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান” আবার আরেকটা বয়সে গিয়ে বলেছেন “মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে”। তাই বয়সের সাথে সাথে মৃত্যু ভাবনাও বদলে যায়।

প্রশ্ন: এই বদলের কথা প্রসঙ্গে বলি, এর পরে যে শব্দটা আমরা পাচ্ছি সেটা হচ্ছে ‘পথ’। সময় বদলেছে, সময়ের সাথে সাথে পথও বদলেছে। মানুষ রাহুলের কাছে সঠিক পথ কি?

রাহুল: যা আমাকে আয়নার সামনে দাঁড়াতে লজ্জিত করবে না, সেটাই আসল পথ। নিজের কাছে আমি স্পষ্ট কিনা সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে।

প্রশ্ন: এখনো পর্যন্ত কোনোদিন আয়নার সামনে দাঁড়াতে লজ্জা হয়েছে? ভুল পথে গেছো?

রাহুল: হ্যাঁ, স্বেচ্ছায় যাইনি বা জেনে যাইনি তবে পথ ভুল হয়েছে একাধিকবার। আমি জানি না তবে পরবর্তী জীবনে যদি আরো একবার সুযোগ পাই তখন হয়তো সেই ভুলগুলো রিপিটও হবে।

প্রশ্ন: শেষ শব্দ ‘যাত্রী’। তোমার মতে, যাঁরা যায় তাঁরা সবাই যাত্রী, না যাঁরা কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে যায় তাঁরা?

রাহুল: আমার লক্ষ্যহীন যাত্রাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।

প্রশ্ন: তোমার যাত্রা কি সবসময় লক্ষ্যহীন থেকেছে?

রাহুল: আমি কোথাও পৌঁছনোর চেয়েও যাত্রাটাকে উপভোগ করতে বেশি ভালোবাসি। মেট্রোতে চেপে অনেক তাড়াতাড়ি পৌঁছনো যায় কিন্তু ট্রামে চারপাশ দেখতে দেখতে যাওয়া যায়।

প্রশ্ন: তুমি ট্রামে চড়তে ভালবাসো?

রাহুল: হ্যাঁ, আমি ট্রামে চড়তে ভালবাসি কিন্তু এখন চড়া হয়না।

প্রশ্ন: এই ভালবাসার কথায় বলি, কোন কোন ভালবাসাকে এখনো মিস করো?

রাহুল: সেরকম সাংঘাতিক ভাবে কিছুই মিসিং নেই। কলকাতা এতটাই ইনক্লুসিভ একটা শহর যে আমি ইচ্ছে করলেই স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে রাধুবাবু-তে গিয়ে একদিন বিকেলবেলায় মটন স্টু আর পাঁউরুটি সেঁকা খেয়ে আসতে পারি, কোনও অসুবিধা হয় না। তাই দিব্যি চলে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন: আমি এখন খুব ‘চুজি’ হয়ে গেছি: মনামী

প্রশ্ন: এবারে আসি ‘মৃত্যুপথযাত্রী’ কথাটাতে। একজন নাগরিক কি একাই মৃত্যুপথযাত্রী হন, নাকি প্রত্যেকবার একবার করে সমাজও মৃত্যুপথযাত্রী হয়?

রাহুল: আসলে আমরা প্রত্যেকেই মৃত্যুপথযাত্রী। আমরা জানি-না জানি, স্বীকার করি-না করি, কিন্তু বাস্তব সেটাই। তবে হ্যাঁ, কিছু কিছু মারণ রোগের ক্ষেত্রে আমরা হয়তো একটা আন্দাজ পাই কিন্তু বেশিরভাগই আমরা জানি না।

প্রশ্ন: তুমি প্রচুর পড়াশোনা করো সেটা তোমার লেখা পড়লে বোঝা যায়। দাদাগিরি’র মঞ্চে প্রতিবারে জয়ের পরে যে প্রকাশ তোমার থাকে তাতে বোঝা যায় তুমি উদ্বেগের মধ্যে থাকো। এত কিছু পাওয়ার পরেও এই বিষয়টা এখনও? বেশিরভাগ মানুষেরই থাকে না।

রাহুল: আমি আসলে ক্যুইজ করতে ভালবাসি। ছোটবেলায় ক্যুইজ করতে কোথায় না গেছি! সার্কিটে রীতিমতো পপুলার ছিলাম আমি ক্যুইজের জন্য। আমি ক্যুইজ এবং তাৎক্ষণিক বক্তৃতা খুব উচ্ছ্বাসের সঙ্গে করতাম। স্কুল থেকে বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হত। স্কুলের সেই কালচারটাও ছিল। তারই একটা এক্সটেনশন দাদাগিরি। আর আমি সব সময় বলি, বই পড়ে আমি কারুর উপর বিন্দুমাত্র দয়া করি না। আমি একেবারেই জ্ঞানী নই। পড়াটা আমার নেশা। অক্ষর দেখলেই আমার এরকম হয়। হয়ত এটার কোনও নাম আছে ইংরাজিতে, আমি ঠিক জানি না।

প্রশ্ন: কি ধরনের বই পড়তে ভালবাসো? ফিকশন না নন-ফিকশন?

রাহুল: এখন নন-ফিকশন হয়ে গেছে। ফিকশন খুব কমই পড়া হয়, তবে নন-ফিকশনের প্রতি অনেক বেশি টান এখন। পুরোনো সময়ের কথা, গদ্য, আত্মজীবনী, জীবনী এগুলো আমাকে খুব আকর্ষণ করে।

প্রশ্ন: এরকম কোনও আত্মজীবনীর কথা মনে পড়ে যেটা পড়ে খুব ইন্সপায়ার্ড হয়েছ?

রাহুল: ইন্সপায়ার্ড ঠিক নয়, তবে অনেকগুলো আত্মজীবনী আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে যেমন ‘মহাস্থবির জাতক’ (প্রেমাঙ্কুর আতর্থী), ‘ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা’ এবং ‘ভালবাসা পৃথিবী ঈশ্বর’ (শিবরাম চক্রবর্তী) খুব গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে। এছাড়াও ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’ (উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়)খুব পছন্দের গদ্য।

প্রশ্ন: এখন বারবার একটা কথা উঠে আসছে, বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ান। তোমার কি মনে হয়, মানুষ বাংলা ছবির পাশ থেকে সরে গেল কেন?

রাহুল: আমরা আর নক্ষত্র তৈরি করতে পারছিনা। তারকা বা নক্ষত্র যেকোনো ইন্ডাস্ট্রির জন্য খুব প্রয়োজনীয়। আমরা যতই বলি যে ‘কন্টেন্ট ইজ্ দ্য কিং’, একটা কথা মনে রাখতে হবে যে একটা ‘গ্যাংস অব্ ওয়সিপুর’ হওয়ার জন্য একটা ‘দবং’ হওয়া দরকার। একটা ‘দবং’-এর টাকা একটা ‘গ্যাংস অব্ ওয়সিপুর’ তৈরি হতে সাহায্য করে। সেইজন্য সলমন খান, শাহরুখ খান, আমির খান বা দক্ষিণী তারকাদের উপস্থিতি এত গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমাদেরকে নক্ষত্র তৈরি করতে হবে আবার, যেটা আমাদের ছিল। তবে আমি বলব, বাংলা ছবির পাশে দাঁড়াবেন না কারণ, এটা কোনও চ্যারিটি নয়। ভাল ছবির পাশে দাঁড়ান।

প্রশ্ন: এটা তুমি সরাসরিই বলে দিচ্ছ?

রাহুল: হ্যাঁ, ভাল ছবির পাশে দাঁড়ান। ভাল বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ান, ভাল হিন্দি ছবির পাশে দাঁড়ান, ভাল যেকোনো ছবির পাশে দাঁড়ান। বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ান বলে আবার আলাদা কি আছে!

প্রশ্ন: ওটিটি’র ভবিষ্যৎ কি দেখছ? ন্যাশনাল ওটিটির থেকে কি বাংলা ওটিটি একটু পিছিয়ে?

রাহুল: আমাদের কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের আরও বেশি টাকা দিতে হবে, তাহলে আরও ভাল কনটেন্ট ক্রিয়েটররা আসবেন। বাংলার কনটেন্ট ক্রিয়েটররা খারাপ একথা বিশ্বাস করা যায় না। অনেক ভাল ভাল ট্যালেন্ট ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তাঁদেরকে এক ছাতার তলায় আনলে নিশ্চয়ই ভাল কাজ হবে। সেক্ষেত্রে নিশ্চয়ই ভবিষ্যৎ ভাল।

প্রশ্ন: টেলিভিশন, বড় পর্দা এবং ওটিটি, তিন জায়গাতেই সমানতালে কাজ করতে চাও?

রাহুল: যে যে পর্দা টাকা দেবে এবং সৎভাবে টাকা দেবে, আমি সেখানেই কাজ করব।

প্রশ্ন: আর মঞ্চের ব্যাপারে কি বলবে?

রাহুল: মঞ্চ একটা অমোঘ সততা, পরিশ্রম এবং ইনভলভমেন্ট ডিমান্ড করে। সেইটা এই মুহূর্তে আমার নেই। আর বিভিন্ন সময়ে কয়েকটা দলে গিয়ে মনে হয়েছে, আমি যখনই ঢুকি অনেকগুলো উঠতি বাচ্চা ছেলেমেয়ে আমার দিকে এমন আশা নিয়ে তাকায় যে আমি ওদের কাজ দেব। কাউকে বুঝিয়ে উঠতে পারিনা যে, কাজ দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। খামোখা অনেককে আশা দেওয়া হয়। আমার এখন কেমন একটা অস্বস্তি হয় কোনও নাটকের দলে ঢুকতে।

প্রশ্ন: মঞ্চে কখনও পরিচালনা করার ইচ্ছে আছে?

রাহুল: না, থিয়েটার ডিরেকশনটা আমি পারব না। ওটা আমার বাবার (বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়) ডিপার্টমেন্ট ছিল। অভিনয়টাই করতাম কিন্তু থিয়েটারের মঞ্চ ভাবনাটা আমি কখনও ভাবিনি।

প্রশ্ন: বলিউডের কাজের কথা কিছু ভেবেছ? বাংলা থেকে তো অনেক শিল্পীই এখন দাপিয়ে কাজ করছেন।

রাহুল: দারুণ দারুণ কাজ করছে। পরম, যিশু দা, অপু দা, স্বস্তিকা, আবীর…আমার খুব ভাল লাগছে। সুযোগ পেলে ভাবা যেতে পারে কিন্তু, আমি আসলে বাংলাতেই স্বপ্ন দেখি তাই আমি হিন্দিতে ভাবতেই পারিনা।

প্রশ্ন: মানে তুমি তোমার সময় মূলত বাংলাকেই দিতে চাও?

রাহুল: হ্যাঁ, আমি আসলে প্রচন্ড বাঙালি। আমার অভিনয়টাই আসলে বাঙালিয়ানা থেকে আসে তাই জানিনা আমি হিন্দিতে পারব কিনা। এ বিষয়ে আমার নিজের প্রতি সন্দেহ আছে।

Loading


Share It