এসএমএস করার সঙ্গে সঙ্গে নাসিরুদ্দিন শাহের উত্তর এল: শৈবাল মিত্র
অতনু রায়
তিনি এক অন্যধারার ছবির পরিচালক। বাংলা ছবির ব্যতিক্রমী পরিচালকদের মধ্যে অন্যতম তিনি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং নাসিরুদ্দিন শাহ-কে এক ছবিতে এনে অসাধ্য সাধন করেছেন তিনি। ‘আ হোলি কন্সপিরেসি’ পরিচালক শৈবাল মিত্র মন খুলে আড্ডা দিলেন।
প্রশ্ন: আপনার ছবিতে আমরা বর্তমান সময়ের খুব ব্যতিক্রমী একটা বিষয় দেখতে পাই। খুব ভাল ভাবে আপনি রাজনৈতিক একটা অবস্থান তুলে ধরেন আপনার ছবির মধ্যে। আপনার ছবি আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক ছবি, আমাদের সমাজের রাজনীতিও আমরা আপনার ছবির মধ্যে দেখতে পাই। আপনি কি শুরু থেকেই এই ধরণের ছবি বানাতে পছন্দ করেন?
শৈবাল: হ্যাঁ, সেরকমই হবে। কারণ, আমার খুব নিরীহ, নির্মল আনন্দের ছবি মাথায় আসেনা। হয়তো এই জন্য যে আমি যে সময়ে চলচ্চিত্র জগতে এসেছি বা যাঁদের সঙ্গে কাজ করে আমি কাজ শিখেছি তাদের একটা প্রভাব পড়েছে। সেটা ছিল অন্যরকমের একটা সময়। সেটা সত্তরের দশক, বাংলায় তখন নতুন ধরণের ছবি তৈরি হচ্ছিল। তখন আমি একজন ছবির টেকনিশিয়ান বা কারিগর হিসেবে কাজ করতে ঢুকি, তারপর থেকে চলছে। সেটাই হয়ত রয়ে গেছে, কারণ আমি যখনই যা কিছু ভাবি এরকমই কিছু একটা ঘটে যায়। আর আমরা একা একা ছবি করি। আমি কোনোদিন ভাড়া খাটি নি। কেউ এসে আমাকে একটা গল্প দিল যে ছবি করে দাও আর পরিচালক হও, এসবের জন্য আমাদের কাছে কেউ আসেও না আর আমিও এসব ক্ষেত্রে যাই না।
প্রশ্ন: সত্তরের দশকে আপনি চলচ্চিত্র জগতে এসেছেন কাদের হাত ধরে আর কাদের সঙ্গে তখন কাজ করেছেন খুব জানতে ইচ্ছে করছে…
শৈবাল: গৌতম ঘোষ, জগন্নাথ গুহ এঁদের সঙ্গেই আসলে আমার কাজ শেখা শুরু। গৌতমের সঙ্গে আমি ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ পর্যন্ত কাজ করেছি। তারপর নিজের কাজ শুরু করি। মাঝে বিপ্লব রায় চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করেছি। তখন আমার সহকারী পরিচালকের জীবন। তারপরে আমি রোলান্ড জোফের সঙ্গে কাজ করি ‘সিটি অফ জয়’ তে। তখন কলকাতায় টেলিভিশনে আমার নিজের কাজ শুরু করি। তখন যে সিরিয়াল বা সিরিজ শুরু হয়, ওই প্রথম যুগের সিরিয়াল মেকার আমি, রাজা সেন, রাজা দাশগুপ্ত, রনজিত রায়, মলয় ভট্টাচার্য। আমরা প্রথমের দিকে কাজগুলো করেছিলাম। একদম প্রথমটা করেছিলেন গৌতম দা, তারপরে আমরা করেছিলাম। তারপরে তথ্যচিত্র করেছি করতে করতে ২০০৫ সালে ‘সংশয়’ করি যেটা ইন্ডিয়ান প্যানোরামাতে দেখানো হয়।
প্রশ্ন: সিনেমাহল যদিও অনেক কমে গেছে তাও একটা জিনিস লক্ষ্য করছি, এই ধরণের ছবি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় না। এর কারণটা কী মনে করেন?
শৈবাল: অনেকক্ষেত্রেই দু-তিন দিন চলার পর ছবি নামিয়ে দেয়, তার পরে হয়ত প্রভাবশালী কারোর ছবি এসেছে তাকে হল দেওয়ার জন্য। সেটা আমার ছবি ‘চিত্রকর’-এর সময়ও হয়েছে। আর হলে যদি রেখে দেওয়া হয়ও তখন খুব বাজে সময় দেওয়া হয়। হয়ত দুপুর বারোটা-একটায় শো দিল। আর ওই সময়ে মাল্টিপ্লেক্সে কে ছবি দেখতে যাবে? তখন হয়ত লোক হচ্ছেনা বলে ছবিটা নামিয়ে দিল। আমার আগের ছবি ‘তখন কুয়াশা ছিল’ নন্দন রেখেছিল, ছ’সপ্তাহ চলেছে।

প্রশ্ন: ‘আ হোলি কন্সপিরেসি’ ছবিতে অনবদ্য স্টারকাস্ট। একদিকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর অন্যদিকে নাসিরুদ্দিন শাহ। আজ সৌমিত্র বাবু আমাদের মধ্যে নেই। এই ছবিকে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কোনও ভাবনা চিন্তা করেছিলেন?
শৈবাল: হ্যাঁ, এই ছবিটাকে অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা এই ছবির প্রযোজকরা করেছেন। তাই বাংলা এবং ভারতবর্ষের অন্যান্য বহু শহরে এই ছবিটা চলেছে। যেহেতু ‘কোট-আনকোট’ একটা স্টার ভ্যালু আছে তাই একটা ঠিকঠাক শো টাইম পাওয়া গেছে। আসলে আমাদের ডিস্ট্রিবিউশন সেক্টরের অনেক সমস্যা। অনেক ভাল ছবি এর শিকার হয়। এবার কোনও একটা ছবি এলেই তো পরের দিনে সবাই সেটা দেখতে চলে যাবেনা, মানুষের দেখবার জন্য ছবিটাকে থাকতে দিতে হয়।
প্রশ্ন: একটা ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং নাসিরুদ্দিন শাহ’-এর মত দুজন মহীরুহকে নেওয়া এবং তাঁদের নিয়ে সুষ্ঠুভাবে কাজটি সম্পন্ন করা। এঁদের মত ‘স্টার’ নিয়ে কাজ করবার সময়ে কোনও বেগ পেতে হয়নি?
শৈবাল: বেগ পাওয়া বলতে সৌমিত্র দা’র স্বাস্থ্য এবং তার আগে আগেই নাসির জীর স্বাস্থ্যের একটু অসুবিধা হয়েছিল সেগুলো একটু খেয়াল রাখতে হয়েছিল তাঁরা যাতে কোনোভাবে অসুস্থ হয়ে না পড়েন। কিন্তু কাজ করার ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধা হয়নি। কাজটা যখন শুরু হয় ওঁরা তো মেতে গিয়েছিলেন। সৌমিত্র দা অনেকদিন পর এমন একজনকে পেলেন যে তাঁর সমকক্ষ এবং নাসির জীও এমন একজনকে পেলেন যিনি তাঁর সমকক্ষ। পরে দেখলাম দুজন একে অপরকে ভীষণভাবে পছন্দ করেন এবং শ্রদ্ধা করেন। আমি শুনলাম যে, ওঁদের নাকি একসঙ্গে একটা ছবি করার ইচ্ছে অনেকদিন থেকেই ছিল। কিন্তু দুজনেরই কোনও ট্যানট্রাম ছিল না। সৌমিত্র দার শরীরের কারণে চার ঘন্টার বেশি শুটিং করতে পারতেন না সেটা আমরা সবাই জানতাম, তাই সেটা বুঝেই পুরো পরিকল্পনা করা হয়েছিল ছবিটার। নাসির জী সেটা বুঝেছিলেন তাই তিনিও সাহায্য করেছেন, এগিয়ে এসেছেন, বলেছেন যে ওঁর শটগুলো আগে নিয়ে নিন। কোনো অসুবিধা হয়নি। আসলে তখন আমরা এমন একটা জগতে ঢুকে যাই যেখানে আলো, ক্যামেরা, অভিনয়ের প্রযুক্তিগত দিক এইসব নিয়েই মেতে থাকি। আর আমি নিজেই যেহেতু ক্যামেরা অপারেট করি, আমার কোনও অসুবিধা হয় না সেই দিক থেকে।

প্রশ্ন: নাসির জী বাঙালি নন, সেই ভাবনা থেকেই কি ওঁর চরিত্রটাকে ছবিতে অবাঙালি হিসেবে রাখার কথা ভেবেছিলেন?
শৈবাল: হ্যাঁ, প্রথমে ছবিটাকে আমি বাংলাতেই করব ঠিক করেছিলাম, তখনও অতটা ভাবি নি। এবার যত ভাবনা চিন্তা এগিয়েছে, তত মনে হয়েছে যে এরকম একজনকে পেলে ভাল হয়। নাসির জী আমাকে চিনতেন না। আমি একটা এসএমএস পাঠিয়েছিলাম যে এরকম একটা ভাবছি আপনি কি রাজি আছেন? আমি যথারীতি ভেবেছিলাম যে উত্তর পাব না কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে উত্তর এল। এসএমএস করে ফোনটা আমি পকেটে ঢোকানোর সময় পাইনি উত্তর এল যে চলে এসো। তারপরে যাওয়া হল, কথাবার্তা হল, চিত্রনাট্য লেখা হল, সেখানে ওঁর পার্টিসিপেশন আর সৌমিত্র দা’র পার্টিসিপেশন দুটোই ছিল। দুজনেই খুব মন দিয়ে আমার সঙ্গে এবং যিনি সংলাপ লিখেছেন (জগন্নাথ গুহ) তাঁর সঙ্গে বসেছেন, কথা বলেছেন, সাহায্য করেছেন। তাঁরা তাঁদের মত করে ভাবতে শুরু করার পরে কিছু কিছু জিনিস চিত্রনাট্যের মধ্যে ঢোকাতে হয়েছে যেগুলো চরিত্রের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। এবার ওঁরা তো আমাদের কাছে শিক্ষক স্থানীয় মানুষ, তাই আমারও কাজ করতে গিয়ে অনেক কিছু শেখা হয়েছে।
প্রশ্ন: সেটে কি ওঁরা ইম্প্রোভাইজ করতেন? একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করেছেন কখনও?
শৈবাল: ইম্প্রোভাইজ ঠিক নয়, তবে লড়াই তো একটা হত। সে এক মজার ব্যাপার আর দেখার জিনিস ছিল। সেটা শুধু আমি একা নয়, যাঁরা সেটে ছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই দেখেছি। সেটা একটা লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্স। এবার যাঁরা ছবি দেখবেন তাঁরাও কিছুটা দেখবেন। কিন্তু আমরা তো জলজ্যান্ত দুটো মানুষকে দেখেছি অভিনয় করছেন, সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা খুব মুশকিল।
প্রশ্ন: ওইরকম দুজন মহীরুহের সঙ্গে অমৃতাকে কাস্ট করার কথা ভাবলেন কেন? অমৃতা খুবই শক্তিশালী অভিনেত্রী কিন্তু ওইরকম দুজন বর্ষীয়ান অভিনেতার সঙ্গে অনেকটাই কম অভিজ্ঞতার জায়গাটা ভেবেছিলেন?
শৈবাল: আমি আজ পর্যন্ত কখনোই কাউকে তাঁর নামের ভারে কাস্ট করিনি। নাসির জীরও যদি চেহারাটা না মিলত আমি কিন্তু কাস্ট করতাম না। অমৃতা, শ্রমণ, কৌশিক বা বিপ্লবদা এঁদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রে একটা জিনিস আমার কাছে প্রথম এবং শেষ যে আমি যে চরিত্রটা ভেবেছি এবং তার যে চেহারাটা আমার মনের মধ্যে আছে সেটার সঙ্গে মিলতে হবে প্রথমে, তাতে সে অনামী হতেও পারে।

প্রশ্ন: অমৃতাকে সহজ করে দেওয়ার ব্যাপারে নাসির জী এবং সৌমিত্র বাবু কিভাবে সাহায্য করেছেন?
শৈবাল: ওঁরা বরাবরই ওদেরকে সহজ করার চেষ্টা করেছেন। ফ্লোরে এমনভাবে মিশতেন, এমনভাবে ঘুরতেন, গল্প করতেন সে লাইটম্যান থেকে শুরু করে যে জল দেয় বা অভিনেতা বা আমরা সকলের সঙ্গে একেবারে বন্ধুর মত। ওখানে আর মনে হত না যে ওঁরা অত বড় মানুষ বা অভিনেতা। হাসি ঠাট্টা করেছেন কিন্তু সময়টাও খুব মেনটেইন করেছেন। আমাদের যেটা হয়েছিল, উনারা কখনো মনে করেননি যে সময় নষ্ট হচ্ছে। কারণ, পরপর শটগুলো হয়ে যাচ্ছে, দুজনেই প্রস্তুত সংলাপ নিয়ে আর আমার একটা স্টোরি বোর্ড থাকে সেই কারণে ওঁরা বুঝতেও পারছিলেন যে পরে কোন শট হবে।
আরও পড়ুন: বয়সের সাথে সাথে মৃত্যু ভাবনাও বদলে যায়: রাহুল
প্রশ্ন: বাংলার দর্শক যাঁরা হলে গিয়ে ছবি দেখবেন, তাঁরা একটা উন্নত মানের বাংলা ছবি দেখবেন…
শৈবাল: …এখানে আমার একটু আপত্তি আছে। এই ছবিটাকে কিন্তু বাংলা ছবি বলে দেখলে হবে না। ছবিটা কিন্তু ইংরাজি সার্টিফিকেট পেয়েছে এবং ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ সংলাপ ইংরাজিতে, সে দিক থেকে এটা একটা সর্বভারতীয় ছবি।
প্রশ্ন: তাহলে কি আমরা ছবিটাকে ইংরাজি ছবি হিসেবেই দেখব?
শৈবাল: হ্যাঁ। অফিশিয়ালি সেটাই, যেহেতু সার্টিফিকেটটা ইংরাজিতেই দেওয়া হয়েছে এবং ভারত সরকার দিয়েছে। সেই জন্যই আমরা ন্যাশনালি যেতে পারছি। কারণ বাংলা ছবি হলে একটা রিজিওন্যাল ছবি হয়, সেটা কেন কেরলের বা দিল্লির বা মহারাষ্ট্রের বা পুনের একটা সিনেমাহল কেন নিতে চাইবে?

প্রশ্ন: একটা ছবি ইংরাজিতে সার্টিফিকেট পাওয়ার পরেও তার যে একটা বড় অংশের সংলাপ বাংলায় রাখা হল, সেটা নিয়ে আপনার কোন অসুবিধা হয়নি? অন্য রাজ্যের সিনেমাহলগুলো কোনও রকমের আপত্তি জানান নি?
শৈবাল: না। কারণ সংলাপগুলো এসেছে খুব লজিক্যালি। যে চরিত্রটি সাঁওতাল সে কিন্তু সাঁওতাল ভাষায় কথা বলেছে। হিন্দি ভাষার ব্যবহার আছে কারণ আদিবাসীরা অনেক সময় হিন্দি ভাষাতে কথা বলেন, বাংলাতে বলেন আবার নিজেদের সাঁওতালি ভাষাতেও কথা বলেন। তাই সংলাপগুলো সেইভাবে এসেছে। বাংলা, ইংরাজি, হিন্দি এবং সাঁওতালি, মোটামুটি চারটি ভাষা বিভিন্ন সময় ব্যবহার করা হয়েছে। একটা দৃশ্য আছে যেখানে পুরো দৃশ্যটাতেই সাঁওতালি ভাষায় কথা বলা হচ্ছে। সেখানে নাসির জীও সাঁওতালি ভাষায় কথা বলছেন। সেই অর্থে এটা একটা বহুভাষিক ছবি এবং ভারতীয় ছবিতে এরকমই হওয়া উচিৎ, তাই না? ভারতে তো কত ভাষার মানুষ রয়েছেন!
প্রশ্ন: কিন্তু ভারতে এই ধরণের ছবি কি খুব বিরল নয়? আমার কাছে অবশ্যই বিষয়টা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা ও তথ্য নেই, কিন্তু এইরকম ভাষার ব্যবহার করে ছবি কি বাংলাতে খুব বেশি হয়েছে? বা ভারতীয় চলচ্চিত্রে?
শৈবাল: না, না, হয়নি। হয়নি তার কারণ নিয়মটা হচ্ছে যে, সার্টিফিকেশন যখন দেয় ওরা দেখে যে কমপক্ষে ৭০ শতাংশ সংলাপ কোন ভাষায় রয়েছে। তাই আমি একে বাংলা ছবি বলতে চাইলেও সেন্সর সেটাকে অ্যালাও করবে না। বাংলা ছবিতে যেহেতু সবটাই বাংলা থাকে, তাই বাংলা হয়। কিন্তু যদি খুব রিয়্যালিস্টিক ছবির কথা ভাবি, তাহলে কোনও জায়গায় একটা চরিত্র আসতেই পারেন যিনি অবাঙালি। দুজন অবাঙালি চরিত্র একটা বাংলা ছবির মধ্যে থাকতেই পারে যাঁরা হয়ত পরস্পরের মধ্যে কথা বলছেন। তখন তাঁরা কেন বাংলায় বলবেন? তাঁরা নিজের ভাষাতেই কথা বলবেন, লজিক্যালি তো তাই হয়।
প্রশ্ন: পশ্চিমবঙ্গে (অন্তত প্রত্যন্ত অংশে) ইংরাজি সংলাপের সঙ্গে বাংলা সাবটাইটেল রাখলেন না ইচ্ছে করেই?
শৈবাল: আমার একটাই প্রিন্ট, ওটাই রেখেছি। নাহলে আবার আমাকে সেন্সর করতে হবে। কারণ সেন্সরে লেখা রয়েছে ‘ইংলিশ উইদ্ ইংলিশ সাবটাইটেল’। একটা ভাবনা হয়েছিল বাংলা করার এবং বাংলা করে দেওয়াও যায় কিন্তু নিয়মের জায়গা থেকে যদি বলে যে আবার সেন্সর কর তখন একটা সমস্যা হবে। তাই আর এটা করা হয়নি, তবে এটা ভাবাও ঠিক নয় যে আমার এই ছবিটা আপামর জনগণ দেখবে আর সেটা আমি আশা করি না। যাঁরা নাচ-গান আনন্দ পেতে ছবি দেখেন এটা তাঁদের ছবি নয়। যাঁরা একটু শিক্ষিত, একটু সমাজসচেতন একটা ভাল কিছু দেখতে চান তাঁরাই আসবেন ছবিটা দেখতে।
প্রশ্ন: এই যে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন ভাষা বলেছেন বিভিন্ন জায়গায়। যেখানে শুটিং করেছেন সেখানকার ভাষা ব্যবহার হয়েছে, একটা সাসপেন্সের ব্যাপারও রয়েছে ছবিটার মধ্যে। এখানে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেসব জায়গায় শুটিং করেছেন সেখানকার লোকাল সাউন্ডস্কেপ ব্যবহার করার কথা ভেবেছিলেন না অন্যভাবে চিন্তা করেছেন?
শৈবাল: ভাবনাটা অনেকটাই ওইরকম ভাবে করা হয়েছে, তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার করেছেন। এখানে একটা অদ্ভুত জিনিস শুনবেন, ‘যীশু কীর্তন’। শুনেছেন কখনো? আমরা কৃষ্ণ কীর্তন শুনেছি। কৃষ্ণের লীলা কীর্তন হয় কিন্তু এখানে ছবির শুরুতেই একটি গান আছে যেটা বাইবেলকে ধরে কীর্তন। বাংলার খ্রিস্টান কমিউনিটির মধ্যে এই ধরণের গানের প্রচলন আছে। এটা একদম কেরি সাহেবের সময় থেকে তৈরি, লোকাল যে টিউন সেই সুরের মধ্যে বাইবেলের কথা বসিয়ে তাঁরা প্রচার শুরু করেন।
প্রশ্ন: অনেকটা কবিগানের ধাঁচে?
শৈবাল: হ্যাঁ, কবিগানের মত আছে। আবার শুধু কীর্তনের সুরেই নয় ভাটিয়ালি সুরেও যীশুর গান আছে। এই একই জিনিস রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের সময়। দেখবেন অনেক গান আছে যেগুলো লোকসংগীতের উপর ভিত্তি করে। লজিকটা একই আর কি। আসলে একটা গণসঙ্গীতের চেহারা দেওয়া। যে সুরটা মানুষ জানে, তাতে কথাটা শুধু বদলে দেওয়া।
আরও পড়ুন: আমি এখন খুব ‘চুজি’ হয়ে গেছি: মনামী
প্রশ্ন: ওটিটিতে মুক্তির ব্যাপারে কিছু ভেবেছেন?
শৈবাল: সেটা হয়ত পরে হবে। আমি কিন্তু মনে করি ছবি হচ্ছে সিনেমাহলের জন্য। আমার খুব একটা পছন্দ নয় যে একটা ছবিকে দুম করে ওটিটিতে রিলিজ করিয়ে দিলাম। পছন্দও নয় আর সম্ভবও হয়নি তার কারণ, ওটিটির ব্যবসাটা যেখান থেকে হয় সেটা এতই দূরে মুম্বইতে যে এই রিজিওন থেকে তাদের কাছে পৌঁছানো আমার জন্য খুব মুশকিলের। আর ওরা পাত্তাও খুব একটা দেয় না। কারণ, দে হ্যাভ দেয়ার কাইন্ড অব্ মুভিজ। আমরা যে ছবি বানাই সেটা ওটিটিতে নেই। আপনি ওটিটিতে ভারতবর্ষের বিখ্যাত পরিচালক যেমন আদুর গোপালকৃষ্ণন, গিরিশ কাসারাভল্লী এঁদের ছবি সেরকম ভাবে পাবেন না। এমনকি গৌতম ঘোষ বা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কিছু পুরোনো ছবি হয়ত পাবেন। কারণ, ওটিটির একদম অন্য জগৎ। ওরা বলে দেয় কি ধরণের ছবি চায়। ওদের একটা অ্যালগরিদম আর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কি একটা গল্প আছে। পরিচালকরা সেই ধরণের ছবিই বানায় এবং সেই সব ছবির বিষয়-আশয় মোটামুটি একই ধাঁচের আন্ডারওয়ার্ল্ড, যৌনতা ইত্যাদি বিষয় নিয়েই। কিন্তু আমার ছবির মত ছবি কোনো ওটিটি নেয় বলে আমি শুনিনি। ভারতীয় ছবির যে বিশাল ব্যপ্তি, সেটা আপনি অসম বলুন বা মিজোরাম, সে কি আপনি ওটিটিতে দেখতে পান? পান না।
প্রশ্ন: যে কজন মানুষ কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটা দেখেছিলেন, প্রত্যেকেই বলেছেন যে অত্যন্ত ভাল একটি ছবি। বাংলা ছবির অন্যান্য প্রযোজকদের কাছেও নিশ্চয়ই এই খবর পৌঁছেছে যে এরকম একটি ছবি হয়েছে কলকাতাতে। কোনও প্রযোজনা সংস্থা থেকে পরবর্তী ছবির অফার পেলেন?
শৈবাল: (হেসে) না, না। আমাকে কেউ অফার করে না। আমাকে আবার নিজেকেই ঝুলি নিয়ে বেরোতে হবে যে ওরে ভাই কিছু পয়সা দিবি ছবি করব! এইভাবেই আমি আছি আর কি।
প্রশ্ন: আপনার কি পরবর্তী ছবির চিত্রনাট্য তৈরি?
শৈবাল: না, এই একটা ছবি রিলিজ। সমস্ত ব্যবস্থাই আমাকে করতে হচ্ছে যাতে প্রযোজকরা পয়সাটা পান। তাঁরা তো বন্ধুস্থানীয় মানুষ এবং আমাকে বিশ্বাস করে টাকাটা খরচ করেছেন এবার তাঁদের টাকা ফেরতের একটা ব্যবস্থা করা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সেটা হোক। এখন ২৯ তারিখের পরে যখন আমি বুঝব যে কিছুটা হলেও তাঁরা টাকাটা ফেরত পাবেন তখন হয়ত আবার একটু মন হবে আর একটা কিছু ভাবা যায় কিনা। কারণ, আমি যেহেতু একাই সব করি তাই এক-একসময় বিষয়টা খুব ক্লান্তিকর হয়ে যায়। এই ছবিটাই দেখুন না, দু’বছর বানানো আর তারপরে আড়াই বছরের অপেক্ষা। প্রায় সাড়ে চার বছরের একটা জার্নি আমার এই ছবিতেই।