পাহাড়ি পথে মন কেমনের স্বাদ, পৌষালীর ‘সূচনা’তে চোখ টানল রূপ-মেঘা
সোমনাথ লাহা
শহুরে কোলাহলমুখরতা থেকে বেরিয়ে শান্ত, কোলাহলহীন পরিবেশে প্রকৃতির বিশালত্বের সামনে দাঁড়ালে উপলব্ধি করা যায় বৃহৎ পৃথিবীতে নিজের অবস্থানটিকে। দিগন্ত বিস্তৃত নীল-কালো, ধূসর, সাদা পর্বতশ্রেণীর সুবিশাল ঘেরা বৃত্তে একরত্তি ক্ষুদ্র মানুষ আমরা। চাওয়া-পাওয়ার হিসেব-নিকেশেই মগ্ন। তখনই ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে মনুষ্যত্বের আসল রূপ। ঘুচে যায় সংকীর্ণতার বেড়াজাল। নিজেকে খুঁজে পাই আমরা।
পরিচালক পৌষালী সেনগুপ্ত-র প্রথম ছবি ‘সূচনা : দ্য বিগিনিং’ সেই পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ ধরে আরও একবার নিজেকে খুঁজে পাওয়া। আমিত্বের বেড়াজালে আটকে পড়া মনকে বৃহৎ ডানা মেলে ওড়ানোর কথা। গুটিপোকা থেকে বেরিয়ে এসে প্রজাপতি হয়ে ওঠা। মনকেমনের মিঠেকড়া সেই স্বাদের রেশ ছড়িয়ে পড়ে মনে-প্রাণে। তাইতো ছবির নামের মতই জীবনকে দেখার আঙ্গিকের এক শুভসূচনা তৈরি হয় এই ছবির হাত ধরেই।
আজকের জেন ওয়াইকে কাজের সূত্রে বেশ কাছ থেকে দেখা পরিচালক তাই সহজেই তাদের সমস্যাকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। নিজের পরিচয় বাঁচানোর তাগিদে সবকিছুই বিদ্যমান তাদের কাছে। সেই কারণেই ছবিতে পাহাড়ের আলো-ছায়ার মতোই সম্পর্কের টানাপোড়েন, ভাললাগা-ভালবাসার অনুভূতিগুলো ছড়িয়ে পড়ে।
চেনা কাহিনিকেই ‘সূচনা: দ্য বিগিনিং’-র হাত ধরে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে বলার চেষ্টা করেছেন পরিচালক। কাহিনি আবর্তিত হয়েছে বছর উনিশের মেয়ে সুমি (মেঘা মুখোপাধ্যায়)কে কেন্দ্র করে। ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যা ও টানাপড়েন তার মনকে বিষন্ন করে দিয়েছে। তাই বাবা-মা ও বোনের সঙ্গে মন ভাল করার লক্ষ্য নিয়ে সিকিমে বেড়াতে এসেছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরিবারের জোরাজুরিতে সুমির এই ভ্রমণ। এই সুবাদেই তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে স্থানীয় ক্যাবচালক বাইশ বছরের যুবক বিনুর (রূপ দেব)। সিকিমে এসে বাবা-মা-বোনের সঙ্গে সে ওঠে হোমস্টে-তে। সেখানে পৌঁছে তারা জানতে পারে পাহাড়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়ে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে খুনের ঘটনা অবধি ঘটে গিয়েছে। এদিকে ঘুরতে আসা সুমির মনের অবস্থা চোখ এড়ায় না বিনুর। শালীনতা ও সম্মান বজায় রেখে কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে তার মনকে হালকা করার চেষ্টা করে বিনু। তবে সুমি পাহাড় ও সবুজের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মধ্যে শান্তি খুঁজে বেড়ায়। তবে এসবের মাঝেই সে বুঝতে পারে বিনুর আচরণে কোনও স্বার্থ নেই। ঘটনাচক্রে একদিন পরিবারের সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে বিনুর সঙ্গে গভীর রাতে লং ড্রাইভে বেরিয়ে অযাচিতভাবে একটি স্থানীয় খুনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে সুমি। এরপর কি হয়! সেটা জানতে হলে পৌঁছতে হবে প্রেক্ষাগৃহে।
পরিচালক পৌষালী সেনগুপ্তকে ধন্যবাদ, প্রথম ছবিতেই সাহস করে দুই নতুন মুখকে সুযোগ দেওয়ার জন্য। এই সময়ের বাংলা ছবিতে চেনা মুখের থেকে বেরিয়ে দর্শকদের অন্য স্বাদ দেওয়ার জন্য। প্রথমবারের জন্য প্রযোজনা ও পরিচালনার ব্যাটন হাতে নিয়েই অন্যভাবে গল্প বলেছেন। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা জনপথে তাই এই রোমান্টিক থ্রিলার ছবির চরিত্রদের মন-মানসিকতা এবং টানাপড়েনের ছবিগুলি পাহাড়ের আলো-ছায়া মাখা আবহাওয়ার মতোই পরিবর্তিত হয়েছে। সিকিমের দৃশ্যপট এতটাই সুন্দরভাবে উঠে এসেছে ছবিতে যে দর্শক একনিমেষে সেই পাহাড়ি জনপথে হারিয়ে যাবেন বড়পর্দায়। শুধু তাই নয়। বেশ কয়েকটি দৃশ্যের নির্মাণও বেশ যত্ন নিয়ে করেছেন পরিচালক।
এবার আসা যাক ছবির অভিনয়ের প্রসঙ্গে। বিনুর চরিত্রে রূপ প্রথম ছবিতেই প্রাণঢেলে অভিনয় করেছেন। পাহাড়ি পথে ক্যাব চালকের ভাবভঙ্গি থেকে শুরু করে স্থানীয় ভাষায় কথোপকথন, সবকিছুর মধ্যেই তাকে পাহাড়ের ছেলে বলেই মনে হয়েছে। তবে অ্যাকশন দৃশ্যে তাকে আরও সাবলীল হতে হবে। আশাকরি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাজের মাধ্যমে আরও ভাল অভিনয় তার কাছ থেকে পাবেন দর্শকরা। সেই প্রত্যাশা থাকবে। অন্যদিকে প্রথম ছবিতে সুমির মত একটি কঠিন চরিত্রে মেঘা যথাযথভাবে চেষ্টা করেছেন। একাকী নিজের মত থাকার দৃশ্যে, এমনকি বিপদের মধ্যে পড়েও ঠান্ডা মাথায় বিনুকে ক’টার মধ্যে হোমস্টে -তে পৌঁছে দিতে হবে, সেই দৃশ্যে তাকে বেশ লেগেছে। তবে রূপের সঙ্গে শটগুলিতে কয়েকটি ক্ষেত্রে তাকে একটু আড়ষ্ট লাগে। তবে সেটা বোধহয় প্রথম ছবির কারণেই। ছবিতে চার্চে মোমবাতির নরম আলোয় মাখা রোমান্টিক দৃশ্যটিতে রূপ-মেঘা দু’জনের রসায়ন মন ছুঁয়ে যায়।
সুমির বাবা ও মায়ের চরিত্রে ইন্দ্রজিৎ চক্রবর্তী এবং অভিনন্দা সেনগুপ্ত যথাযথ। বিশেষ করে ইন্দ্রজিতের সঙ্গে মেয়ের সম্পর্কে কথা বলা এবং মেয়ের সঙ্গে মায়ের মনোমালিন্যর দৃশ্যগুলিতে অভিনন্দার সাবলীল অভিনয় চোখ টেনে নেয়। ছবির কার্যনির্বাহী প্রযোজনার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অভিনয়টাও বেশ ভাল করেই করেছেন তিনি। মিষ্টি লাগে সুমির বোনের চরিত্রে অভিনয় করা মেয়েটিকেও।
ছবির অন্যতম বড় সম্পদ এই ছবির গানগুলি। অর্ক সেনের কম্পোজিশনে শ্রেয়ান ভট্টাচার্য-র গাওয়া ‘এ কোন সকাল’ গানটির রেশ থেকে যায় বহুক্ষণ। এছাড়াও শোভন গঙ্গোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘হঠাৎ দেখা’, রাইয়ের কন্ঠে ‘ওই যে অসীম আকাশ’ গানগুলি ছবির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। গানগুলি ছবির কাহিনিকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। ছবির এন্ড ক্রেডিটে রূপের গাওয়া ‘আয় চলে আয়’ গানটিও বেশ। ছবির আবহসংগীতও দৃশ্যের গুরুত্ব অনুযায়ী যথাযথ। সবমিলিয়ে অর্ক সেন সংগীত পরিচালক হিসেবে নিজের দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। প্রশংসা প্রাপ্য সিনেমাটোগ্রাফার বিক্রম আনন্দ সবরওয়ালের। সিকিমের দৃশ্যপটকে চমৎকারভাবে ধরেছেন তিনি। সেটা প্রাকৃতিক দৃশ্যপট হোক বা রাতের দৃশ্য।
তবে তার মাঝে ছবিতে দুর্বল কিছু বিষয়ও রয়েছে। ছবিতে পাহাড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়টিকে স্থানীয় টেলিভিশনের খবর সহ বিনুর সংলাপে বিল্ড আপ দিলেও সেই টেনশনের অনুভূতিটা বোঝা যায় না। শুধু একটি জটলায় গাড়ি আটকা পড়া দিলেই হয় না। এটায় আরেকটু নজর দিতে পারতেন পরিচালক। হোমস্টেতে ঘরের বাইরে থেকে জানলা দিয়ে দেখে (আদৌ ওভাবে বোঝা যায় কিনা!) সুমির ঘরে থাকার বিষয়টি তার মাকে জানানোর বিষয়টি বড্ড বোকাবোকা মনে হয়। হোমস্টে-র বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বিনুর গাড়িতে করে বিনু-সুমি রাতে লং ড্রাইভে বেরিয়ে গেল অথচ কেউ বুঝতে পারল না। বিষয়টি কি এতটাই সহজ ছিল!
ছবির সবচেয়ে দুর্বলতার জায়গা হল ছবির অ্যান্টাগনিস্ট। রাজনৈতিক দলের সেই গুন্ডাটির চরিত্র ঠিকমত লেখাই হয়নি। বরং তাকে দেখে মনে হয় কোনও জায়গা থেকে ভাড়া করে নিয়ে আসা হয়েছে। পাহাড়ের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক এটা মনেই হয় না। যেহেতু তার চরিত্রটি দুর্বল তাই সুমি-বিনুর বিপদে পড়ার টেনশনের দিকটা সেইভাবে অনুভব করা যায় না। বিশেষ করে ইন্টারভ্যালে এত ভাল একটি ক্লিফ হ্যাঙ্গার রাখার পরেও। পাহাড়ে গড়াইয়ে কেউ আচমকা ঠেলে দিলে ভয়ে চিৎকার করে ওঠার কথা কিন্তু সেরকম কিছু সুমির চোখে-মুখে ধরা পড়েনি। পুলিশ সেই মুহূর্তে সেখানে চলে আসার দৃশ্যটি যেন হঠাৎ করেই হয়ে গেল।
তবে এসবের পরেও বলব ছবিটি বড়পর্দায় দেখুন। কারণ পোঙ্গিলা প্রোডাকশনের ব্যানারে পৌষালী সেনগুপ্ত-র ছবি ‘সূচনা :দ্য বিগিনিং’ দুই নতুন মুখকে নিয়ে একটি এমন সুন্দর প্রয়াস যেটির পাশে দর্শকদের দাঁড়ানো উচিত। ছবির শেষে অম্ল-মধুর স্বাদের ছোঁয়া পাবেন দর্শকরা।