মন্ত্র দিয়ে রোবোটিক সার্জারি সুধীর শ্রীবাস্তবের, নতুন দিগন্ত চিকিৎসাশাস্ত্রে

Share It

চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রতিনিয়ত কিছু না কিছু নতুন উদ্ভাবনের কথা আমরা শুনতে পাই। তেমনভাবেই শল্য চিকিৎসা বা সার্জারির ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিলেন ডা: সুধীর প্রেম শ্রীবাস্তব। সম্পূর্ণ ভারতীয় পরিকাঠামোয় তিনি উদ্ভাবন করেছেন এমন এক যন্ত্র, যা রোবোটিক সার্জারিকে এনে দেবে সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে। একান্ত আলোচনায় ডা: শ্রীবাস্তব খুঁটিনাটি জানালেন তাঁর আবিষ্কৃত যন্ত্র, ‘মন্ত্র’ নিয়ে।

দীর্ঘ ৪০ বছর মার্কিন দেশে চিকিৎসক হিসেবে থাকা সুধীর বলেন, “ভারতে এসে আমি দেখলাম যে রোবটিক সার্জারির ক্ষেত্রে লাগামছাড়া খরচা হচ্ছে। কারণ রোবটিক সার্জারির জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিটা ইক্যুইপমেন্ট বিদেশ থেকে আনতে হয় ফলে দাম অনেক বেশি পড়ে। সেই কারণেই চিকিৎসার খরচও মাত্রাতিরিক্ত হয়। আমার মনে হল যে সমস্ত মানুষ এই সার্জারির সুফল নিতে পারছেন না। তাই আমি আরও আধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্র অনেক কম দামে তৈরি করার কথা ভাবি। যাতে অনেক বেশি মানুষ এই চিকিৎসার উপকারিতা নিতে পারেন।” রোবোটিক সার্জারির ক্ষেত্রে রোগীর ট্রমা অনেক কম হয়, সার্জারির পরে অনেক তাড়াতাড়ি হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া যায়, জটিলতা কম তৈরি হয়, ঔষধও কম খেতে হয় বলেও জানান তিনি।

এই ভাবনা থেকেই ডা: শ্রীবাস্তব সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি করেছেন একটি মাল্টি আর্ম নভেল টেলি রোবোটিক অ্যাসিট্যান্স যন্ত্র। নাম দিয়েছেন ‘মন্ত্র’। বিদেশ থেকে আমদানি করতে যে যন্ত্রের খরচ হত আনুমানিক ১৫ কোটি টাকা, সেই কাজের জন্যই ‘মন্ত্র’ কিনতে খরচ হবে কমবেশি ৫ কোটি টাকা। এস এস ইনোভেশনের তৈরি এই যন্ত্র ভারতীয় চিকিৎসা পরিষেবায় একটা আমূল পরিবর্তন আনবে বলেই মনে করছে চিকিৎসক মহল। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন রাজ্যের চিকিৎসকেরা উৎসাহ দেখিয়েছেন এবং বিভিন্ন হাসপাতাল আগাম এই যন্ত্রের অর্ডার দিয়েছে বলে জানালেন ডা: শ্রীবাস্তব।

১৪০ কোটি মানুষের দেশে ৭০ হাজারের বেশি হাসপাতাল থাকলেও রোবটিক সার্জারির ইক্যুইপমেন্ট তখন ১০০ টা এবং বিদেশ থেকে আনা ১৫-১৮ কোটি টাকার যন্ত্রের কারণে সাধারণ সার্জারির থেকে রোবোটিক সার্জারিতে কয়েক লক্ষ টাকা অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে। এই ব্যাপারটাই সূত্রপাত করে ‘মন্ত্র’ যন্ত্রের। “আমাদের দেশের ট্যালেন্ট কাজে লাগিয়েই সম্পূর্ণ ভারতীয় প্রযুক্তিতে তৈরি করেছি এই যন্ত্র। আমাদের খুবই দুর্ভাগ্য যে এত ট্যালেন্ট থাকা সত্ত্বেও আমাদের ৮০ শতাংশ চিকিৎসার ইক্যুইপমেন্ট বিদেশ থেকে আনতে হয়”, বলেন ডা: শ্রীবাস্তব। তিনি আরও জানান, এখন এই যন্ত্র সম্পূর্ণ তৈরি এবং আগামী তিন মাসের মধ্যেই যন্ত্রটিকে আনুষ্ঠানিক ভাবে বাজারে আনতে চলেছে তাঁর সংস্থা এস এস ইনোভেশন।

রোবোটিক সার্জারি নিয়ে বেশ কিছু ভুল ধারণা ভেঙে দিতে চেয়ে ডা: শ্রীবাস্তব বলেন, “অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ ভাবেন বা বলেও থাকেন যে রোবট অপারেশন করবে। তা কিন্তু একেবারেই নয়। এটা কম্পিউটারের মাধ্যমে চালানো হলেও এর কন্ট্রোল সম্পূর্ণভাবে সার্জেনের হাতে থাকে। গাড়ির মত বিনা চালকে এই যন্ত্র কাজ করবেনা”। কম্পিউটার প্রযুক্তির পাশাপাশি বিল্ট-ইন ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করা হয়েছে এই যন্ত্রে। তবে চিকিৎসকদের ‘মন্ত্র’চালনার ট্রেনিং দেওয়া হবে এবং সার্জারির সময়েও সম্পূর্ণ সহযোগিতা করা হবে।

বিদেশে তৈরি যন্ত্রের থেকে মন্ত্র একেবারেই আলাদা সেকথাও মনে করিয়ে দেন তিনি। “এটা সম্পূর্ণ অন্য ধরণের একটা যন্ত্র এবং ইতিমধ্যেই আমরা ১৬০টা পেটেন্ট ফাইল করে রেখেছি। দাম কম হলেও মানের দিক থেকে কোনো রকমের আপস করা হয়নি”, জানান সুধীর।

তথ্য অনুযায়ী, ভারতে বর্তমানে ছশো’র কাছাকাছি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। তাঁরা পোস্ট গ্রাজুয়েট কারিকুলামে রোবোটিক সার্জারি বিষয়টাকে অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছেন। বেশি পরিমাণে দক্ষ রোবোটিক সার্জেন তৈরি হলে ছোট শহর বা গ্রামের মানুষের কাছেও পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া যাবে বলে মনে করেন ১৪০০র বেশি রোবোটিক সার্জারি করা এই চিকিৎসক।

আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের কথা উল্লেখ করে সুধীর বলেন, “ভারতে বেশিরভাগ মানুষ স্বাস্থ্য বীমার আওতায় পড়েন। কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প যেমন রয়েছে তেমনভাবেই পশ্চিমবঙ্গ আর রাজস্থানে সরকারের পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বছরে ৫ লক্ষ টাকা, যাতে অতি সহজেই রোবোটিক সার্জারি করা সম্ভব। তাই আমরা প্রত্যেক রাজ্য সরকারের সাথে কথা বলতে চাই এই পরিষেবা নিয়ে”।

আপাতত গুরগাঁও শহরের উদ্যোগ বিহারে এই যন্ত্র তৈরির পরিকাঠামো রয়েছে। ইতিমধ্যেই দিল্লি, ছত্তিশগড়, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, হায়দ্রাবাদ থেকে অর্ডার এসেছে। দিল্লির রাজীব গান্ধী ক্যান্সার হাসপাতালে সফল ট্রায়ালও হয়েছে ‘মন্ত্র’র। সরকারি, বেসরকারি সব ধরণের হাসপাতাল থেকেই জানতে চাওয়া হচ্ছে যন্ত্রের বিষয়ে।

বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্ডার এলেও প্রথম প্রথম যন্ত্র ডেলিভারির জন্য ৩-৪ মাস লাগবে জানিয়ে ডা: শ্রীবাস্তব বলেন, “শুরুতে মাসে ১০ টা ইউনিট তৈরি করতে পারব আমরা। চলতি বছরে যেটুকু সময় রয়েছে তাতে কমবেশি ৪০ টা ইউনিট তৈরি করা যাবে। তবে প্রত্যেক বছরই সেটা বাড়বে। আগামী বছর থেকে আমরা বছরে ১৫০-২০০ টা ইউনিট তৈরি করতে চাই। ৫ বছরের মধ্যে বছরে ১০০০ টা ইউনিট তৈরির লক্ষ্যমাত্রা রেখেছি আমরা”।

অন্য দেশে এই যন্ত্রের ব্যবসার বিষয়ে ডা: শ্রীবাস্তব বলেন, “ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং নেপাল থেকে বিভিন্ন চিকিৎসক এসে ‘মন্ত্র’ পরীক্ষা করেছেন এবং দেখেছেন। আফ্রিকা মধ্যপ্রাচ্য সহ পৃথিবীর আরও ৫৫টি দেশ নিয়েও আমরা ভাবছি। এছাড়াও আমরা ইউরোপিয়ান রেগুলেটরি অ্যাপ্রুভাল নিতে চাই এবং আমেরিকা সহ অন্যান্য দেশেও এই যন্ত্র বিক্রির চেষ্টা করব। তবে দেশের চাহিদা মেটানোর পরেই আমরা আন্তর্জাতিক লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করব”।

Loading


Share It