অভিনয় করতে না পারলে আমার বাঁচার কোনও কারণ থাকবে না: তানিকা

Share It

অতনু রায়

যাঁরা সিনেমা নিয়ে চর্চা করেন তাঁরা খুব বলেন ‘নন লিনিয়ার’। এই ‘নন লিনিয়ার’ শুধুমাত্র সিনেমাতেই যে হয় তা তো নয়! এই সাক্ষাৎকারটাও ‘নন লিনিয়ার’ বলতে পারেন। একটা আড্ডা। আড্ডা যাঁরা দেন, তাঁরা জানেন আড্ডা সাধারণত অগোছালো হয়। এটা তেমনই এক অগোছালো আড্ডা। আবার কিছু অগোছালো জিনিস, গোছাতে নেই। এই সাক্ষাৎকারটা তেমনই। গোছালে অরিজিন্যালিটিটাই নষ্ট হয়ে যাবে। তাই অগোছালোই থাকল। ২০২৪ এর বাংলা ছবির অন্যতম সেরা চরিত্র ফ্রেন্ডস কমিউনিকেশন প্রযোজিত প্রতিম দাশগুপ্ত’র ‘চালচিত্র’ ছবির পুতুল। যাঁরাই চালচিত্র দেখেছেন, সবাই পুতুলের কথা বলেছেন, বলছেন। সেই পুতুল, মানে তানিকা বসু এক আড্ডায় বললেন অনেক কথাই।

প্রশ্ন: প্রতিম আমাকে সাক্ষাৎকারে বললেন, ‘পুতুল’ চরিত্রে তিনি অডিশনের মাধ্যমে তোমাকে নিয়েছেন। এই অডিশন ব্যাপারটা এখনও বাংলায় খুব কম, হিন্দি বলয়ে কিন্তু অডিশন বেশ ভালভাবে জারি আছে।

তানিকা: একদম। আমি তোমাকে বলছি, আমি এইটা যেমন অডিশন দিয়ে পেয়েছি তেমনই সম্প্রতি অনুরাগ কাশ্যপের একটা কাজের জন্যও অডিশন দিয়েছিলাম। সেই কাজটা পাইনি বলে সেটা খবরে প্রকাশ হয়নি। আমি একটা ছবিতে তিন রাউন্ড অডিশন দিয়ে ‘টপ ২’তে গেছি। এবং সেখান থেকে আমি এই কারণে বাদ গিয়েছি যে আমার ইনস্টাগ্রামে তেমন বেশি ফলোয়ার নেই।

প্রশ্ন: এই একই অভিজ্ঞতার কথা প্রিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়ও আমাকে জানিয়েছেন। অডিশন দিয়ে পাওয়া একটা চরিত্র একজন অভিনেতা কোন জায়গায় পৌঁছে দিতে পারে তার প্রমাণ পুতুল। কিন্তু বাংলায় বেশিরভাগ অডিশনই তো আই-ওয়াশ!

তানিকা: একদম। এটা আমার নিজের সঙ্গে হয়েছে। ধরো, কেউ আজকে একটা অডিশন নিচ্ছে। সে কিন্তু অডিশন নেওয়ার আগেই ঠিক করে নিয়েছে সে কাকে নেবে। অনেকের ক্ষেত্রেই এটা হয় যে, সে তার বান্ধবীকে বা বন্ধুকে বা আত্মীয়কে এই চরিত্রটায় নেবে। সবসময় যে এটা খুব রোম্যান্টিক রিলেশনশিপের উপর নির্ভর করে নেওয়া হয় তা কিন্তু নয়। কেউ চাইছে বন্ধু, বান্ধবী, ভাই বা বোন হলে তার সাথে কাজ করতে সুবিধা হবে, তাকে ভাল হ্যান্ডল করতে পারবে। কিন্তু বৃহত্তর স্তরে দেখাতে হবে যে একটা অডিশন করছি।

প্রশ্ন: ঠিক।

তানিকা: আমার সঙ্গে এরকমও হয়েছে, আমার অডিশন দেখে অন্যকে অডিশন করানো হয়েছে! আমার বক্তব্য, তুমি যখন আমার অডিশন দেখিয়ে অন্যকে কাজ করাচ্ছো তাহলে আমার অডিশন করলে কেন? তুমি বলতেই পারতে আমি এরকম একটা ওয়র্কশপ করতে চাইছি বা কিছু, তুমি একটা শুট করে দাও তো। সেটা দেখিয়ে আমি ওয়র্কশপটা করাবো। সেখানে তুমি মিথ্যে বলে আমাকে অডিশন করাচ্ছ আর আমার অডিশনটা দেখিয়ে অভিনয় করাচ্ছ জুনিয়র অ্যাক্টরদের। আমি তো নিজেও একজন ট্রেইনার। তাহলে তুমি আমাকে সেটার জন্যই বলো! তুমি সেটা বলছ না। তুমি মিথ্যে বলছ!

প্রশ্ন: আবার কাউকে বলা হচ্ছে যে, তুমিই এই চরিত্রটা করছ। তাঁকে অপেক্ষায় রেখে, না জানিয়েই বাদ দেওয়া হচ্ছে। সে খবর পড়ে জানতে পারছে যে অন্য কেউ চরিত্রটা করছে। এবার যার কাজ সম্পর্কে ধারণা আছে সে তো বুঝতেই পারে যে যিনি এলেন তিনি সত্যিই বেশি যোগ্যতার কারণে এলেন কিনা! তেমনই কোনও চরিত্র তুমি অডিশন দিয়ে পেলে না, অন্য কেউ পেল বা উল্টোটা, বোঝা তো যায়ই।

তানিকা: এরকম কতবারই হয়েছে যে, কোনও চরিত্রে আমি আমার সমসাময়িক কারোর সঙ্গেই অডিশন দিয়েছি। কখনও আমি পেলাম, সে পেল না আবার কোথাও সে পেল, আমি পেলাম না। এটা হতেই থাকে। আমাদের কিন্তু খুব সুস্থ-স্বাভাবিক সম্পর্ক। আমাদের কথা হয়। সে আমার থেকে কিছু শিখল আর আমি তার থেকে কিছু শিখলাম। এটাই তো হওয়া উচিত। কিন্তু সেটা তো হয় না। অনেক সময় আমরা শেষ মুহূর্তে জানতে পারি। আর সত্যি অনেক সময় জানতেই পারি না, খবরের কাগজ খুলে দেখি যে এই রোলটা অন্য কেউ করছে। আমার সঙ্গে যে এরকম কত হয়েছে তা গুনে শেষ করতে পারা যাবে না।

প্রশ্ন: এটা আমাকে অনেকেই বলেছেন, তাঁরা একটা চরিত্রের জন্য নিজেদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে শুরু করেছেন, সমস্ত কিছু ঠিক আছে। হঠাৎ একদিন খবরের কাগজে কিংবা ফেসবুকে দেখেন মহরতের ছবি, তাঁর চরিত্রটা অন্য কেউ করছে!

তানিকা: কিছুদিন আগেই আমার এক বন্ধুকে একটা ছবিতে হিরো হিসেবে এক মাস শুটিং করানো হল। তারপর হঠাৎ একদিন তাকে না জানিয়েই তার জায়গায় আরেকজনকে নিয়ে নেওয়া হল। খবরটা সে কাগজ পড়েই জেনেছে। একটুখানি সুস্থ স্বাভাবিক কমিউনিকেশন আশা করা অন্যায়? এটুকু জানানো যায় না যে, আমার প্রোডাকশন হাউস তোমাকে চাইছে না তাই তোমাকে নিতে পারছি না, অন্য কাউকে নিচ্ছি? এটুকু তো একটা মেসেজ পাঠালেও হয়ে যায়। আমি জানি না কেন মানুষ কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলে না। তবে এর উল্টোপিঠও আছে। সবাই না হলেও আমি অনেক পরিচালককেই জানি যাঁরা ভীষণ কনভিন্স করার চেষ্টা করেন। তাঁরা বলেন, এখানে একজন ভাল অভিনেতাকেই নিতে হবে, না হলে চরিত্রটা করতে পারবেন না। অনেক প্রোডিউসার শোনেন, অনেকে শোনেন না।

প্রশ্ন: যেকোনো অভিনেতার কাছে পরিচালকের চাওয়াটাই আসল। তোমার কাছে প্রতিমের ব্রিফ কী ছিল?

তানিকা: এখানে একটা ব্যাপার খুব মজার হয়েছে। আমি আর প্রতিমদা সোশ্যাল মিডিয়ায় যুক্ত। আমি প্রতিমদাকে ফলো করি, ফলো ব্যাক আসে। সেই সূত্রেই প্রতিমদাকে মেসেজ করেছিলাম যে, তুমি কেমন আছো? তোমার কাজ আমার খুব ভাল লাগে। প্রতিমদাও জিজ্ঞাসা করল আমি কেমন আছি। এইরকম টুকটাক কিছু কথাবার্তা, ব্যস্। আমাদের কিন্তু কখনও কাজ হয়নি। আমি ওঁর কাজ দেখেছি, ওঁর সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছে আছে। গত বছর অগস্ট মাসে প্রতিমদার সহকারী দেবমাল্য আমাকে ফোন করে করে বলে যে এরকম একটা ছবি হচ্ছে, সেইটার একটা চরিত্রের জন্য আমার অডিশন চাই। এবার, বাংলার ক্ষেত্রে আমি সবাইকে যেটা জিজ্ঞাসা করি, এক্ষেত্রেও তাই করেছি। কী রকম চরিত্র? এটা কি প্রাইমারি চরিত্র? ক’টা সিন? কতটা ইম্পর্ট্যান্ট চরিত্র? দেবমাল্য তখন বলে, “আমি এটুকুই তোমাকে বলতে পারি যে এটা একটা থ্রিলার। এর বেশি আমি আর কিছু বলতে পারব না। তবে এটুকু বলতে পারি, লিড নয়”। আমি বলি, ঠিক আছে তাতে অসুবিধা নেই। কিন্তু লিড কারা করছে? দেবমাল্য তখন বলে, লিড কারা করছে সেটাও বলা যাবে না!

প্রশ্ন: যাহ!

তানিকা: বলল, “এখানে চারজন পুলিশ অফিসার রয়েছে। চারজনের বিপরীতে চারজন নারী চরিত্র। তুমি তাদের একজনের মেয়ে”। আমি বলি, আমার শুনে মনে হচ্ছে যে বিষয়টা খুবই আনইম্পর্ট্যান্ট। এবং সেকেন্ডারি ক্যারেক্টার। তখন বলল, “হয়ত”। আবার আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ক’টা সিন আছে?

প্রশ্ন: তুমি যে ‘ঘর পোড়া গরু’, সে তো আর দেবমাল্য বুঝছে না

তানিকা: (হেসে) হ্যাঁ। বলল, “দেখো আমি তো পুরো ডিটেইলে তোমাকে বলতে পারব না, কিন্তু আমার মনে হয় তিন-চারটে সিন আছে”। এইটা শুনে আমার একটু ডাউট হল। কারণ, আগে আমার সঙ্গে এরকম হয়েছে যে সিন বাদ গেছে। হতেই পারে যে বলা হল তিনটে সিন, তারপর দেখা গেল দুটো আছে, একটা কেটে গেছে।

প্রশ্ন: সে তো আকছার।

তানিকা: এরকমও হয়েছে যে কোনও সিনই নেই। একটা গান আছে আর সেই গানে আমি এত বেশি করে আছি যে লোকে বুঝতেই পারছে না যে আমি একটা গানে কী করছি যে গোটা সিনেমাতে আমি নেই! এইজন্য আমি এখন সবাইকে এটা আগে বলে নিই। আমি এই ধরণের চরিত্র এখন আর করতে চাই না। তারপরে ‘ইন্দু’ করার পরে আমি একটা সাফল্য পেয়েছি। এবার ছোট চরিত্র বারবার করলে ইন্ডাস্ট্রি টাইপকাস্ট করে দেয় এবং ছোট চরিত্রেই ডাকতে থাকে। তাই আমি ছোট রোল করতে চাইছিলাম না। দেবমাল্যকে বললাম, তুমি আমাকে একটু ডিটেইলে বলো কারণ ‘কালা’ রিলিজ করবে পরের মাসে। সেটা আমার বলিউড ডেব্যু। আমি ‘কালা’র পাশাপাশি ছোট কিছু করতে চাই না।

প্রশ্ন: ইন্টারেস্টিং তো!

তানিকা: দেবমাল্য বলল, “তুমি করবে না!” আমি বললাম, তুমি তাহলে স্ক্রিপ্টটা পাঠাও। আমি পড়ে বলছি। ও তখন বলল, “না, স্ক্রিপ্ট পাঠানো যাবে না”। আমিও তখন বললাম, তাহলে কিচ্ছু করার নেই। এরপর প্রতিমদা আমাকে মেসেজ করে, “শোন, এটা খুব চ্যালেঞ্জিং একটা রোল। তুই অডিশনটা দে। আমার মনে হয় অডিশনটা দিতে তোর ভাল লাগবে। তুই অডিশনটা দে, তারপরে দেখা যাবে কী হয়!”

প্রশ্ন: বাহ্।

তানিকা: প্রতিমদা মেসেজ করার পরে আমার মনে হয়, পরিচালক নিজে যখন মেসেজ করেছেন তাহলে অডিশনটা তো আমাকে দিতেই হবে। তারপরে প্রতিমদার সহকারী পরিচালক আমাকে আমার অংশটুকুর স্ক্রিপ্টটা পাঠান। তার আগে পর্যন্ত কেউ আমাকে বলেনি যে এটা একটা অন্যরকম চরিত্র…একজন স্পেশ্যালি এবলড্ মানুষের চরিত্র। আমি কিচ্ছু জানতাম না। নাথিং। আমার বাবার চরিত্র কে করছেন, সেটাও না। আমি দুটো সিন পড়ি। একটা হচ্ছে আমার ইন্ট্রোডাকশন সিন, আর একটা আমার বাবা চলে যাওয়ার পরের সিন। এই দুটো সিন পড়ে আমি রিয়্যালাইজ করি যে এটা অন্য ধরণের একটা চরিত্র। এবং যদি খুব ছোটও হয়, সেটা ছবি থেকে বাদ যাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। আর একটা কথা ভাবলাম, হয় আমি চরিত্রটা খুব ভাল করব নয়তো খুব খারাপ করব। এইটার মাঝামাঝি কিছু হবে না বুঝে গিয়েছিলাম। এটা ভেবেই আমি অডিশনটা দিতে চাই।

প্রশ্ন: খুব ভাল মাইন্ডসেট।

তানিকা: জানো, আমি এটা কীভাবে দেখি? আমি রোলটা আর করার সুযোগ পাবো কিনা সেটা তো আমি জানি না। যদি আর কখনও সুযোগ নাও পাই, একবার তো পাচ্ছি। সেটা হচ্ছে অডিশনে। আমি একবার রোলটা করার মজাটা নিয়ে নিতে চাই। পুতুলের জন্যও আমি সেভাবেই অডিশন দিয়েছি। জানি আমি রোলটা পাব না। কারণ, আমি তখন জেনে গেছি কারা অভিনয় করছেন সেখানে। এত বড় বড় অভিনেতা! ওঁদের স্ট্যান্ডার্ডের আমি মোটেই নই। এদিকে আবার আমার ইনস্টাগ্রাম ফলোয়ারও নেই।

প্রশ্ন: বাহ্। অ্যাহেড অব টাইম ভাবনা তো?

তানিকা: (হেসে) সবকিছু ভেবে নিয়েছি। মনে হল, অডিশনটা ভাল করে দিই। আমি সেরিব্রাল পলসি স্টেজ ফোর নিয়ে রিসার্চ করলাম যতটা সম্ভব। অডিশনটা দেওয়ার পর আমার মনে হল, হয়তো হলেও হতে পারে। আমাকে এটাও বলা হয়েছে, অনেক সমসাময়িক তাবড় অভিনেতা চরিত্রটার জন্য অডিশন দিয়েছেন। আমাকে যদিও তাদের নাম বলা হয়নি। প্রতিমদাকে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, অডিশনটা দিয়ে খুব ভাল লাগল। এবারে দিন দশেক পরে জানতে পারলাম, আমি রোলটা পেয়েছি।

প্রশ্ন: এই জার্নিটাই একটা শর্ট ফিল্ম!

তানিকা: তা ঠিক। এবার আমার ভীষণ ভয় লাগতে শুরু করল। মনে হতে লাগল, যদি খুব খারাপ করি তাহলে তো ট্রোল হব! আর এখন তো ট্রোলের ট্রেন্ড চলছে।

প্রশ্ন: হ্যাঁ। ব্যাপারটা এখন পার্সোনাল লেভেলে চলে যায়।

তানিকা: একদম ঠিক। একেবারেই পার্সোনাল লেভেলে চলে যায়। তবে প্রতিমদা আমাকে বলেছে, “চিন্তা করিস না”।আমার প্রথম দুটো ওয়ার্কশপ হয়েছে অনলাইনে গুগল মিটে। প্রতিমদার সাপোর্টের পাশাপাশি আমি প্রচুর ভিডিও দেখেছি। ইউটিউবে সেরিব্রাল পলসির বিভিন্ন স্টেজের ভিডিও দেখতাম। বিশেষ করে একটা স্টেজ ফোর মেয়ের প্রচুর ভিডিও দেখতাম। শুটিংয়ের আগেও আমি তার ভিডিও দেখতাম। ‘মার্গারিটা উইদ্ আ স্ট্র’ দেখেছি দু’বার। সেরিব্রাল পলসি আর অটিজম সংক্রান্ত যা যা পেয়েছি, পরপর দেখে গেছি। বুঝতে পেরেছিলাম, চরিত্রটা খুব টেকনিক্যাল। এখানে ফেসিয়াল মাসল্, বডি মুভমেন্টের বিষয়গুলো খুব টেকনিক্যাল। তাই আমি চেষ্টা করেছি, যতটা কাছাকাছি যাওয়া যায়।

প্রশ্ন: যাঁরা ছবি দেখেছেন, জানেন, তুমি ‘পুতুল’ হিসেবে একদম দশে দশ।

তানিকা: (হেসে) আর ইমোশনাল দিক থেকে যে ইম্প্যাক্টটা তৈরি হয়েছে, সেটার জন্য কিন্তু প্রতিমদা, টোটাদা (রায়চৌধুরী) আর অনির্বাণদা (চক্রবর্তী) দায়ী। সাবর্ণীদি (দাস), অনিরুদ্ধদা (চাকলাদার) এবং হেমাদি (মুন্সী) যেভাবে আমার লুক আর চুলটা ডিজাইন করেছেন তাতে পুতুল ভীষণ মায়াবী একটা লুক পেয়েছে। তারপরে যেভাবে অন্তরাদি (লাহিড়ি) এডিট করেছে, ওই সময় বিজিএমটা যেভাবে ঢুকছে…ম্যাজিকটা কিন্তু একটা টিমওয়র্কে হয়ে গেছে। তুমি তো ছবিটা দেখেছ, তুমি বুঝতে পারবে।

প্রশ্ন: সে তো ভাল ছবি মাত্রই দারুণ টিমওয়র্ক। কিন্তু পুতুলের ম্যাজিক যেটা, সে তো তুমিই ফুটিয়ে তুলেছ। তোমার যে এফোর্ট, সেটা তো মিথ্যে হয়ে যেতে পারে না! আমি বরং বলব, এই ধরণের চরিত্র আমরা বাংলা ছবিতেই অনেকদিন পরে দেখলাম। এখানে সাধারণত যেগুলো করা হয়, সেগুলো প্রচন্ডই হাস্যকর হয়। কিন্তু অনেকদিন পরে পুতুলকে তুমি আলাদা উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছ।

তানিকা: আরও একজনের নাম আমি অবশ্যই বলব, বেণী। আমি বেণীর সাহায্য নিয়েছি। কারণ, বেণী আমার কোচ। আমি এই ছবিটার আগে বেণীর সঙ্গে বসতে পারিনি, কিন্তু ফোনে বা বিভিন্নভাবে যেটুকু যা টিপস্ দরকার, আমি ওঁর থেকে নিয়েছি। এবার দেখো, আমি সব চরিত্র একইরকম সততার সাথে করার চেষ্টা করি। কিন্তু কিছু চরিত্র থাকে, ক্লিক করে যায়। আমি ‘আবার বছর কুড়ি পরে’ও খুব চেষ্টা করেছি। সুনামও পেয়েছি। ‘বিজয়ার পরে’ করেও আমি অনেক ভালবাসা পেয়েছি। কিন্তু ‘চালচিত্র’র মতো চরিত্র আমি আগে করিনি।

প্রশ্ন: তুমি এত ভিডিও দেখলে। সাধারণভাবে কী হয়, মানুষের প্রভাবিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু নিশ্চয়ই একজন অভিনেত্রী হিসেবে তুমি চেয়েছিলে তোমার স্বকীয়তা বজায় থাক? এবার খুব বড় চরিত্র হলে, চরিত্রটার যথেষ্ট বিল্ড-আপ থাকলে, একটা সময় পাওয়া যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে চরিত্রটা ঢুকছেই একটা ধাক্কা দিয়ে। তৈরি করার সময় তো তুমি পাচ্ছ না।

তানিকা: ইনফ্যাক্ট, গোটা ছবিতে মাত্র চারটে সিন আছে।

প্রশ্ন: হ্যাঁ। সেইখানে তো তোমাকে আরও ডায়রেক্ট হতে হচ্ছে। তুমি মাথায় কী রেখেছিলে?

তানিকা: আমি দশ বছর ধরে অভিনয়ের প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। প্রথমত আমি বিশ্বরূপ স্যারের কাছে ক্লাস করেছি। তারপরে আমি ২০১৬ থেকে বেণীর কাছে ঢুকেছি। ওঁর কাছে আমি এখনও শিখছি। আমি প্রত্যেকটা চরিত্র করার আগেই ওঁর সঙ্গে অল্প-বিস্তর কথাবার্তা বলার ব্যাপারটা রাখি। আর বেণী একজন সাংঘাতিক টিচার। ওঁর নিজের অভিনয় দেখলেও বোঝা যায়, ও কী জিনিস! ট্রেইন্ড অ্যাক্টরদের একটা কোনও প্রসেস তো নিশ্চয়ই আছে যেভাবে তাঁরা চরিত্রটায় ঢোকে বা সেটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু সেটা বলে বোঝানো অনেক সময়েই সম্ভব হয় না। আমি শুধু একটা বিষয় মাথায় রাখার চেষ্টা করি। চরিত্রটা কীভাবে ভাবে। আমি এটুকু জানি, চরিত্রটা আর যাই হোক তানিকার মতো করে ভাববে না। তাই সে কীরকম ভাবে, সেইটা বুঝতে চেষ্টা করি। পুতুল তো পুতুলের মতো করেই ভাববে। পুতুলের ইন্টারন্যাল সাইকি’টা কীরকম হবে, সেইটা আমাকে অনেকটা সাহায্য করে।

প্রশ্ন: খুব স্ট্রাকচারড্।

তানিকা: আর আমি প্রচন্ডভাবে আমার সহ-অভিনেতাদের উপর নির্ভরশীল। তুমি যেহেতু ছবি দেখো, বুঝতে পারবে, আমার অন্যান্য কাজেও সহ-অভিনেতারা আমাকে যেভাবে সিন দিয়েছেন, আমি সেভাবেই রিয়্যাক্ট করেছি। এটা কিন্তু অনেক অভিনেতাই করে থাকেন। এখানেও কিন্তু অনির্বাণদা, টোটাদা বা শেষে রাইমাদির সঙ্গে একটা সিনে ওঁরা আমাকে যেভাবে দেখছে সেটা আমাকে এত অ্যাফেক্ট করছে যে আমাকে আলাদা করে কিছু করতে হচ্ছে না। যেটা দেখছ, খুব ন্যাচারালি এবং ইনস্টিঙ্কটিভলি আমার মধ্যে থেকে বেরোচ্ছে। তার সঙ্গে ক্রাফ্টটা তো আছেই। আমি চেষ্টা করি, মানুষের কোনোভাবেই যেন মনে না হয় যে আমি তানিকা বা আমি অভিনয় করছি। আমি চাইছি অভিনয়ের মধ্যে ডুবে যেতে। আর অভিনয় করে আমি এতটাই মজা পাই যে আমি অভিনয়টা ভীষণ ভালবেসে করি। তাই আমি বেশি ভাবিও না আর আমার এত স্ট্রেসও হয় না। তাই একটু প্রিপেয়ার করলেই আমার মনে হয়, এইতো হচ্ছে। আমি মজাও পাচ্ছি, হয়েও যাচ্ছে! আসলে জানো, অভিনয় করতে না পারলে, আমার জীবনে বাঁচার আর কোনও কারণ থাকবে না।

প্রশ্ন: খুব সুন্দর ভাবে বললে।

তানিকা: আর প্রতিমদা আমাকে খুব ভাল ডিরেক্ট করেছে। হয়তো কোনও জায়গায় বলেছে, এটা এভাবে বল বা এভাবে বলিস না বা এতটা কথা বলিস না অথবা এর থেকে একটু কম কথা বল, এরকম। কারণ, আমি খুব ইম্প্রোভাইজ করি। এই চরিত্রেও আমি অনেকগুলো জায়গায় ইম্প্রোভাইজ করেছি। কোথাও কম বলেছি, কোথাও বেশি। এত হাত নাড়তাম যে হাতে কালশিটে পড়ে যেত। সবাই বলত, একটু আস্তে, এত হাত নাড়ছিস যে কালশিটে পড়ে যাচ্ছে! কিন্তু সেটাই তো মজা। এটা নয় যে, হাতে কালশিটে পড়ে যাচ্ছে বলে মজা পাচ্ছি। আসলে এমন কিছু একটা করছি, যেটা নতুন। যেটা আমি আগে কখনও করিনি, জানি না পরেও কখনও এরকম চরিত্র করতে পারব কিনা। ওইটাই আমার ভালবাসার জায়গা। ভালবেসে কিছু করলে সেটা একটা অন্যরকম রেজাল্ট দেয়। রেজাল্টের জন্য তো কাজ করি না, ভালবেসে করি। এবার সেটা ভাল হয়ে গেলে, ভাল।

প্রশ্ন: সেইভাবে যদি দেখি, পুরুষের পার্সপেক্টিভ থেকে বানানো চারটে পুরুষ চরিত্রের ছবি। নারী চরিত্রগুলোর জন্য যে বিরাট কিছু রাখা আছে তেমনটা নয়। শুধু প্রত্যেক নারী চরিত্রের পরতগুলো আলাদা। এর থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র তুমি আগে করেছ। কিন্তু ‘চালচিত্র’ নিয়ে জাতীয় স্তরেও কথা হতে শুরু করেছে। এটা কি তোমার জন্য একটা নতুন অ্যাভিনিউ খুলে দিল? কারণ, পুতুল তোমাকে ‘লং ডিউ’ রিকগনিশনটা দিল।

তানিকা: আমিও মন থেকে চাই সেটা হোক। কারণ, বাংলার কথা যদি বলো, অনেকেই আমাকে চেনে। যাঁরা ছবি করেন বা কাজ করেন তাঁরাও জানেন, আমি বারবার বলেছি, আমি তাঁদের সঙ্গে কাজ করতে চাই। তাঁরা হয়ত আজ এই কাজটা দেখে মনে করবেন যে সত্যিই কাজটা করতে পারব। আর জাতীয় স্তরে বলতে গেলে আমি একটাই কাজ এখনও করেছি। বিজয় নাম্বিয়ারের ‘কালা’। এটাও ঠিক যে খুব কম মানুষেরই ডেব্যু বিজয় স্যারের মতো পরিচালকের ছবির মাধ্যমে হতে পারে। কম মানুষের কপালেই হয়ত সেটা থাকে। ‘কালা’ও আমি সাত রাউন্ড অডিশন দিয়ে পেয়েছি। আমি আশা করেছিলাম যে আরও কিছু কাজ হয়ত আমি জাতীয় স্তরে পাব। অডিশন আমি প্রচুর দিয়েছি, হয়নি। আমার কাছে লিড করা বা বড় চরিত্র করাটা বড় কথা নয়, আমার কাছে দর্শকের ভালোবাসা পাওয়াটাই আসল। আমি সত্যিই চাই জাতীয় স্তরে মানুষ ছবিটা দেখুক। কারণ, কিছু মানুষের সঙ্গে কাজ করার স্বপ্ন আমার আছে।

প্রশ্ন: স্বপ্নের কথা বলা যাবে?

তানিকা: একদম। কে না চায়, মনি রত্নমের সঙ্গে ছবি করতে? রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরা, ইমতিয়াজ আলি! স্বপ্নের সব পরিচালক! আমার মনে আছে, যখন প্রথমবার ‘রং দে বসন্তি’ দেখি তখন আমি ক্লাস থ্রি। আমার মনে হচ্ছে যে একজন অভিনেতার যদি এরকম ইম্প্যাক্ট থাকতে পারে, তাহলে আমি অভিনয়ই করব। যাঁদের কাজ দেখে অভিনয় করতে আসা, আমি তো অবশ্যই চাইব যে তাঁদের কাছে আমার কাজটা একটু হলেও পৌঁছক। ওঁরা যদি কেউ কখনও আমার ছবি দেখে মনে করেন ঠিক আছে, এই মেয়েটাকে পরের ছবির অডিশনে ডাকতে পারি! এইটুকু পেলেই তো আমি আমার স্বপ্নের অনেক কাছাকাছি পৌঁছে যাব। মানুষের হয়ত ঈশ্বর ভাবনাটা আলাদা, আমার কাছে ভগবান হল ভালবাসা। আমার অভিনয়, আমার ক্রিয়েটিভিটি দিয়ে আমি যদি দর্শকদের হৃদয়টা ছুঁতে পারি, আমার কাছে সেটাই ঈশ্বরপ্রাপ্তি।

প্রশ্ন: এই ছবিতে তোমার সহ-অভিনেতা প্রিয়া আমাকে বলছিলেন, মুম্বইতে ওঁর টিমের সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দিয়েছেন। তোমাকে মুম্বইতে গিয়ে কাজ করতেও বলেছেন। তুমি এই জায়গাগুলো এক্সপ্লোর করতে চাইছ?

তানিকা: অবশ্যই চাই। ‘কালা’ করার পরেও আমি ভেবেছিলাম যে আমি মুম্বইতে আরও বেশি কাজ পাব। তাও মুম্বইতে যত অডিশন পেয়েছি, কলকাতায় তো অডিশনও পাইনি। তাও আমি যথেষ্ট আশাবাদী। আমি ফারহান আখতারের একটা সিরিজের জন্যও অডিশন দিয়েছিলাম। তবে হিন্দিতে যেটা ভাল লাগে, ওখানে প্রচুর ভাল ভাল অভিনেতা। তাই কম্পিটিশনটা অনেক বেশি। অনেকক্ষেত্রেই সেটা হেলদি। তবে অতনুদা, মুম্বই এমন একটা শহর যেখানে কাজ করতে গেলে সেখানে গিয়ে থাকতে হবে।

প্রশ্ন: ঠিক বলেছ একদম।

তানিকা: যেমন স্বস্তিকাদি (মুখোপাধ্যায়), ঋতাভরী (চক্রবর্তী) দু’জায়গাতেই থাকে। চিত্রা (চিত্রাঙ্গদা) তো ওখানেই থাকে। ও আমার স্কুলের সিনিয়র। দুর্দান্ত অভিনেত্রী।

প্রশ্ন: কিন্তু ভাল অভিনেতা যেমন এখানেও আছেন, ওখানেও আছেন। একটা কথা বলতেই হয়, যে ধরণের কনটেন্ট বা অভিনেতাদের কাজ তুমি পছন্দ করো তা এখানে হচ্ছে ভীষণ কম। এ তো অনস্বীকার্য, একটা ভাল চরিত্র পেতে গেলে তার জন্য একটা ভাল চরিত্রের লেখা হওয়া প্রয়োজন। একটা ভাল চিত্রনাট্য প্রয়োজন। কিন্তু বাংলায় সব থেকে কম টাকা খরচ হয় লেখার জন্য। কয়েকজন পরিচালক, যাঁরা সত্যিই লিখতে পারেন, তাঁদের বাদ দিলে বাকিদের কাছে লেখাটা একটা কম্পালসনের জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে। কারণ, চিত্রনাট্য এবং সংলাপের জন্য এত কম টাকা বরাদ্দ হয় যে কোনও ভাল চিত্রনাট্যকার শুধু এই কাজটা করতে চান না। তাই অনেকক্ষেত্রেই পরিচালকদেরকে সেই কাজটা প্যাকেজে করে দিতে হয়।

তানিকা: কী দুঃখজনক ভাবো! যারা লেখে, তাঁদের জন্য এটা কতটা দুঃখের। মূল গল্প, চিত্রনাট্য, যাঁরা লিখবে তাদেরকে টাকা দেওয়া হবে না বা কম টাকা দেওয়া হবে। এবার স্বাভাবিক, কে লিখবে? কেন লিখবে? ভাল লেখক তুমি কেন পাবে কম টাকায়! তখনই তাঁরা মুম্বইতে চলে যাচ্ছেন বা অন্যান্য জায়গায় চলে যাচ্ছেন। এগুলো ঘটতেই থাকবে।কিন্তু আমি বাঙালিকে যেটুকু বুঝি, তাঁরা যতই বাইরে কাজ করুক, নিজের ঘরেই যদি সেই জায়গাটা তারা না পায় একটা ফাঁক থেকে যায় মনে।

প্রশ্ন: তোমার কাজের ধারাটা আলাদা। তুমি যে ধরণের ওয়ার্ক প্রসেসে বিশ্বাসী, সেটাও আলাদা। কিন্তু বাংলায় এখনও রিকগনিশন পেতে গেলে, তাঁর কমার্শিয়াল ছবি কতদিন সিনেমাহলে চলছে, সে কত বড় পোস্টারের মুখ, এই ধরণের কিছু প্যারামিটারের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তুমি হয়ত অন্য ধারার কাজে বেশি সাবলীল, কিন্তু আমরা একদম হার্ডকোর কমার্শিয়াল ছবিতে তোমাকে দেখতে পাব?

তানিকা: আমাকে শেষ দশ বছরে ইন্ডাস্ট্রি বুঝিয়েছে, আমাকে চট করে কেউ হিরোইনের চরিত্রে কাস্ট করবে না। সেটা আমি জানি, কারণ তাঁরা আমাকে সেই ভাবে দেখেই না। আমাকে কতজন বলেছে, আমি হিরোইন মেটেরিয়াল নই। এই নোংরা কথাটা আমাকে বারবার শুনতে হয়েছে। আমি নোংরা কথাই বলব, কারণ, মেটেরিয়াল কী! মেটেরিয়াল বলে তো কোনও কথা হয় না। একজন অভিনেতা কেবলই একজন অভিনেতা। আমি যদি কোনও একটা বিশেষ চরিত্রে তাঁকে দেখতে পাই,.তাহলে তাকে নেব। না হলে নেব না। আমি হার্ডকোর কমার্শিয়াল ছবি করতে চাই। আমি সবকিছু করতে চাই। কারণ, আমি মনে করি যদি আমি একশোভাগ কনসেনট্রেশন দিয়ে কোনও কিছু করতে পারি, তাহলে মানুষের কাছে সেটা বিশ্বাসযোগ্য হবেই।

প্রশ্ন: বুঝলাম।

তানিকা: পরিচালক যদি আমাকে সেই চরিত্রটায় দেখতে পান, আমার মনে হয় আমি সেই চরিত্রটা করতে পারব। দেখতে পাওয়ার অর্থ কী? আমাকে চরিত্রটায় দেখতে গেলে আমার লুক, হেয়ারস্টাইল, মেকআপ, সমস্ত কিছুই তো এর মধ্যে যাচ্ছে। আমাকে যেরকম দেখতে, পুতুলকে তো সেরকম দেখতে নয়। অনেক জায়গায় গিয়ে মানুষ বুঝতেই পারছেন না যে আমি পুতুল! মানুষকে বলে দিতে হচ্ছে। যখন শুনছে, তখন অবাক হয়ে যাচ্ছে। যাঁরা বলেন, আমার মনে হচ্ছে ওকে ওই চরিত্রটায় মানাবে না…তুমি জানছ কী করে? তুমি দেখো আগে! অবশ্যই মানাবে, কিন্তু তোমাকে সেটা দেখতে পেতে হবে।

প্রশ্ন: কিন্তু যদি প্রয়োজনে একটা বেছে নিতে হয়, পুতুলের মতো চরিত্র আর হার্ডকোর কমার্শিয়াল ছবির লিড। কোনটা বাছবে?

তানিকা: আমাকে যদি কোনোদিন অফার করা হয় বেছে নেওয়ার জন্য, একদিকে পুতুলের মতো একটা চরিত্র আর অন্যদিকে একদমই অন্য রকমের একটা কমার্শিয়াল ছবি চরিত্র যেটায় হয়ত আমার সেরকম কিছু দেওয়ার নেই, তাহলে সব সময় বেছে নেব পুতুলের মতো চরিত্রটাই। যেকোনো দিন আমি একটা চ্যালেঞ্জিং রোল বেছে নেব। পুতুল যে পোস্টারে থাকবে, সেটাও আমি জানতাম না।

প্রশ্ন: তাই!

তানিকা: সত্যি। একটা পোস্টার হয়েছে যেখানে মাঝখানে পুতুল রয়েছে, সেটা যে হবে আমি জানতাম না। এমনকি আমি যখন ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি’ করছি তখনও আমি জানতাম না যে একটা ছ’জনের ফ্যামিলি পোস্টারে আমার ছবি থাকবে। আমি সত্যিই এসব নিয়ে ভাবি না। আমি দেখি আমার চরিত্রটা গল্পকে ইমপ্যাক্ট করছে কিনা আর আমার নতুন করে কিছু দেওয়ার আছে কিনা। ‘বিজয়ার পরে’তে আমাকে পরিচালক অভিজিৎদা একটা অন্য চরিত্র অফার করেছিলেন। আমি স্ক্রিপ্ট পড়ার পরে অভিজিৎদাকে নিজে বলি, আমি পরিচারিকার চরিত্রটা করতে চাই, আমাকে একটু অডিশন দেওয়ার সুযোগ দাও। লুকসেটের আগের দিনে সেই অডিশন দেওয়ায় ওরা সবাই কনভিন্সড হয় এবং তারপরে আমি চরিত্রটা করি। তার আগে পর্যন্ত অভিজিৎদা আমাকে নিজে বলেছেন, “আমি তোমাকে ওই রোলটায় ভাবতে পারছি না কারণ, তুমি তো খুব গ্ল্যামারাস”।

প্রশ্ন: এই ভাঙার চেষ্টাটা দরকার।

তানিকা: আমি সবসময় নিজেকে ভাঙতে চাই। সবসময় চেয়েছি যতটা অন্যরকম চরিত্রের চ্যালেঞ্জ আমার কাছে আসে। তবে কমার্শিয়াল ছবিও করতে চাই। জানিনা আমাকে কেউ কখনও কমার্শিয়াল ছবিতে ভাববে কিনা। তবে আমি শুধুমাত্র আর্ম ক্যান্ডি হয়ে থেকে যাব, তেমন সংলাপ থাকবে না বা সারা ছবি জুড়ে সুন্দর সুন্দর শাড়ি-গয়না পরে ঘুরব, সেটাও করতে চাই না। আমি চাই, আমার দুটো বা তিনটে সিনও যদি থাকে সেখানে আমার যাতে কিছু করার থাকে। যে সময় হাতে কোনও কাজ নেই, বসে আছি, কেউ এরকম কিছু অফার করল ছোটখাটো, হয়ত সেটাও করে দিচ্ছি কিন্তু এটা যদি অপশনের প্রসঙ্গ আসে, তখন তো কখনোই নয়। অপশন থাকলে, আজকেও তুমি যদি বলো টিভি না সিনেমা? আমি বলব সিনেমা। যদি বলো সিনেমা না নাটক? আমি বলব নাটক। এই প্রেফারেন্সগুলো আমার চিরকালই থাকবে।

প্রশ্ন: নাটকের কথা উঠল। জিজ্ঞাসা করি, নাটক নিয়ে নতুন কী ভাবনা আছে?

তানিকা: নাটক নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই বলব, আমাদের দলের যে নাটকের পরিচালক, অভ্রজিৎ সেন, তাকে আমরা প্রত্যেকে সব সময় বলি এবার আর একটা নাটক করো। পরিচালক যদি নাটক না করে কী করব! এই করতে করতে আমরা একবার করে দেখা করি, প্রচন্ড আড্ডা হয়, অনেক কথা হয় পরবর্তী নাটক কবে হবে সেই নিয়ে, কিন্তু আমরা প্রত্যেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এত ব্যস্ত যে সেই নাটক আর মহলার মুখ দেখে না। কথাবার্তা চলছে, আশা করছি ২০২৫-এ একটা নতুন নাটক নামাতে পারব। ভীষণ রকমের ইচ্ছে তো আছেই। কলকাতায় যদি কিছু নাও করতে পারি, আমি চেষ্টা করব মুম্বইতে গিয়ে নাটকে কিছু একটা করতে। কারণ, মুম্বইতে নাটকের চিত্রটা অনেক ভাল। অনেক বেশি মানুষ নাটককে সাপোর্ট করে। অনেক বেশি মানুষ নাটক প্রযোজনা করার জায়গায় আছেন। দেখা যাক, আমি তো অন্তত আশাবাদী।

প্রশ্ন: তুমি খুব গুছিয়ে কথা বলো। আমি যদি খুব ভুল না হয়ে থাকি, তাহলে তুমি একটা শর্ট ফিল্মের চিত্রনাট্য লেখার দায়িত্বও পালন করেছ…

তানিকা: …হ্যাঁ। ঠিক বলেছ। আসলে এটা ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই জানে না। আমি লিখিও। অনেকক্ষেত্রে আমি ঘোস্ট রাইটিংও করেছি বা ক্রেডিট না নিয়ে লিখি। অনেক সময় এরকমও হয়েছে যে কেউ আমাকে বলেছে, “তুই এটা লিখবি?” কিন্তু, রেমুনারেশন হয়ত সেরকম মনে হয়নি বলে লিখিনি। কিন্তু আমি লিখি। নিজের কিছু প্রজেক্ট খুব প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। কয়েকটা হয়ত ফার্স্ট ড্রাফ্ট হয়েছে। ‘ইলিপ্সিস্’ নামে একটা শর্ট ফিল্ম কো-রাইট করেছিলাম। পরিচালক ছিলেন অভিরূপ হালদার আর একজন। এখনও পর্যন্ত কোনও ওটিটিতে নেই ছবিটা। কিছুদিন মুবি’তে ছিল। সেভাবে তারপরে এখনও পর্যন্ত কিছু করা হয়নি। একটু অন্য রকমের ছবি। একটু ডার্ক। সম্প্রতি, রৌনক দাসের প্রথম ছবি ‘কাঠের খাঁচা’য় লিখেছি। রৌনক এর আগে একজনের চিত্রনাট্য লিখেছে কিন্তু এটা ওর প্রথম ছবি। ছবিটাতে আমি এবং অর্ঘ্য রায় বলে একজন অভিনয় করেছি। রৌনকের সঙ্গে কিছু কিছু সিন আমি এবং অর্ঘ্য দুজনেই লিখেছি। যেরকম ‘বিফোর সানসেট’ আর ‘বিফোর মিডনাইট’ ছবিতে ইথান হক – জুলি দেলপি করেছিলেন। রিহার্স করতে করতে যেটা হয়, একটা সংলাপ ভাবলাম, সেটা লিখলাম, তেমন। আমরা দীর্ঘদিন একসাথে লিখেছি। আমার লিখতে খুবই ভাল লাগে, তাই লিখি। অনেক সময় ফেসবুকেও অনেক রকমের লেখা পোস্ট করি। তবে এখন তো সব ক্ষেত্রেই মানুষ খুব ক্রিটিসাইজ করতে থাকেন, তাই এখন বেশি লেখা দিই না।

প্রশ্ন: একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। যাঁরা লেখেন না তাঁদেরকে এই প্রশ্নটা করা যায় না। একটা মানুষ যখন চিত্রনাট্য লেখে, একটা চরিত্রকে তৈরি করতে পারে। সে একটা চরিত্রকে একরকম ভাবে দেখে। এবার পরিচালক সেই চিত্রনাট্য পড়তে পড়তে তাঁর ভাবনায় চরিত্রটাকে অন্যরকম ভাবে দেখেন। আবার অভিনেতা চরিত্রটাকে আরেকরকম ভাবে দেখেন। তিনজনের ভাবনা সম্পূর্ণ আলাদা। এবার যেহেতু ছবি পরিচালকের মাধ্যম, আমরা পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গিকে গুরুত্ব দিই। একটা চরিত্র শোনার সময়ে দু’জন তানিকার মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়া উচিত। মানে অভিনেতা তানিকা হয়ত একরকম ভাবে চরিত্রটা শুনছে আর চিত্রনাট্যকার তানিকা চরিত্রটাকে আরেকরকম ভাবে পারসিভ করছে, এই দ্বন্দ্বটা কি কখনও হয় তোমার মধ্যে?

তানিকা: একদম ঠিক বলেছ। তুমি লেখো বলেই হয়তো তুমি এই প্রশ্নটা আমাকে করতে পারলে। আমার মনে হয় যাঁরা লেখেন তাঁরাই একমাত্র এটা বুঝতে পারবেন, না হলে বোঝা খুব মুশকিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সত্যিই এটা হয়। বিশেষ করে ‘কাঠের খাঁচা’তে আমার এতটা ইনভল্ভমেন্ট ছিল যে সত্যিই অনেক সময় আমার মনে হয়েছে যে অভিনেতা হিসেবে আমি এটা এরকম চাই। যখন আমি অভিনয়টা করতে যাচ্ছি, তখনও মনে হচ্ছে এটা খুব রোম্যান্টিক হবে বা অভিনয়ের দিক থেকে অন্যরকম হবে। তারপর যখন আমি লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভাবছি, তখন কোথাও গিয়ে মনে হচ্ছে যে এটা হয়ত অতিরিক্ত হয়ে গেছে। হয়ত মনে হচ্ছে, এই সিনটারই প্রয়োজন নেই! পুরো সিনটাই হয়ত ফেলে দিতে হচ্ছে। তাই একজন লেখক হিসেবে চিত্রনাট্যটাকে দেখতে পারলে একটা বৃহত্তর পারসেপশন পাওয়া যায়। কিন্তু সেটা তো সবসময় সম্ভব হয় না। ‘চালচিত্র’র ক্ষেত্রেই তো থ্রিলার বলে প্রতিমদা সবাইকে পুরো গল্পটা বলেননি। যেহেতু আমি নাটকটা করেছি, পরিচালক অ্যালাও করলে তাই আমি কিছুটা ইম্প্রোভাইজ করার চেষ্টা করি। পুতুলের ক্ষেত্রেও করেছি কয়েকটা জায়গায়। সেগুলো প্রতিমদার পছন্দ হয়েছে, রাখতে দিয়েছেন।

প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রিতে একটা কথা কিছু অভিনেতাদের নিয়ে বলা হয়, ‘ডিরেক্টর্স অ্যাক্টর’। পরিচালক যেভাবে চান সেই ছাঁচে ফেলে নিতে পারেন তাঁদের। কিন্তু আমি অনেকের সঙ্গে ‘চালচিত্র’ নিয়ে কথা বলে এবং এখন তোমার কথা শুনেও বুঝলাম প্রতিম তাঁর অভিনেতাদের অনেকটা খোলা হাত দেন। এখানে যে কথাটা উঠে আসছে সেটা হচ্ছে ‘অ্যাক্টর্স ডিরেক্টর’। প্রতিমের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন? ‘অ্যাক্টর্স ডিরেক্টর’ বলা চলে?

তানিকা: অসাধারণ। প্রতিমদার মধ্যে একটা জিনিস দেখলাম, যখন বুঝতে পারে যে অভিনেতা এমন কিছু একটা দিচ্ছে সেটা ঠিকঠাক তাহলে একদম খোলা হাত দিয়ে দেয়। আর হচ্ছে প্রতিমদা কিন্তু জানে, কী চাই। প্রত্যেকটা সিন নিয়ে ওঁর এত ক্ল্যারিটি যে সবসময় অভিনেতাদের খুব ডিরেক্ট করেন তেমনও নয়। বরং এক এক সময় সেটে এমন কিছু সিচুয়েশন তৈরি করেন যে ওই সময়েই অভিনেতা প্রয়োজনীয় জিনিসটা দিয়ে দেয়! এবং সেটার জন্য সেটে কী কী রেডি রাখতে হবে, প্রতিমদা জানেন। এটা আমি বেশ কিছু পরিচালকের মধ্যে দেখেছি। ওঁর মধ্যেও দেখলাম।

প্রশ্ন: গোছানো আর কী!

তানিকা: যখন একজন অভিনেতা হিসেবে আমি দেখি যে আমার পরিচালকের একটা পরিষ্কার ধারণা আছে তিনি কী চান, তখন নিজেরও একটা আলাদা কনফিডেন্স তৈরি হয়। মনে হয়, যাই হোক, খুঁটিটা খুব স্ট্রং। কাজের প্রতি কনফিডেন্সটা বেড়ে যায়। আমি বলব অঞ্জনদার কথা। অঞ্জনদার সঙ্গে আমি দুটো ছবিতে অভিনয় করেছি। অঞ্জনদা অবশ্যই একজন কিংবদন্তি গায়ক, সঙ্গীতকার বা পরিচালক…সমস্ত কিছু ঠিক আছে। কিন্তু আমি সবসময় মনে করি অঞ্জনদা প্রথমে একজন অভূতপূর্ব অভিনেতা, তারপরে সবকিছু। আমি যখন অঞ্জনদার পরিচালনায় কাজ করেছি, দেখেছি, অঞ্জনদা হচ্ছেন প্রপারলি একজন ‘অ্যাক্টর্স ডিরেক্টর’। এইরকম আমি আর কাউকে দেখিনি। উনি যে একজন অভিনেতার থেকে কী বার করে আনতে পারেন! তাই অ্যাক্টর্স ডিরেক্টরদের সঙ্গে কাজ করার যে সুযোগ পাওয়া কিন্তু দারুণ ব্যাপার।

প্রশ্ন: আবার একটু ওয়র্কশপে ফিরি। এই নিয়ে সম্প্রতি ভিন্নচর্চা হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, ওয়র্কশপ অনেকক্ষেত্রে অভিনেতাকে কোনও একটা জায়গা থেকে বেঁধে দেওয়া। আবার অনেকে মনে করেন, চরিত্রটা হয়ে উঠতে ওয়র্কশপের জুড়ি মেলা ভার। এক্ষেত্রে অভিনেতা তানিকা বসু এবং ট্রেইনার তানিকা বসুর মধ্যে কোনও দ্বন্দ্ব আছে?

তানিকা: প্রথমে একটা কথা বলব, ওয়র্কশপ হোক না হোক একজন ট্রেইন্ড অভিনেতা তাঁর পার্টটা ঠিক নিজের মতো সাজিয়ে নেবেন। কারণ তিনি অনুশীলনরত। আমি তো প্রধানত কলকাতাতেই কাজ করি, ওয়র্কশপ করার খুব সুযোগ যে পেয়েছি, তা কিন্তু নয়। অধিকাংশ কাজেই ওয়র্কশপ করার সুযোগ পাইনি। একটা দুটো কাজে আমি অন্য অভিনেতাদের ওয়র্কশপ করিয়েছি। কিছু ইন্ডিপেন্ডেন্ট কাজে বা একদম নতুন কোনও ওটিটি লঞ্চ হচ্ছে সেখানে হয়ত তিনজন অভিনেতাকে নেওয়া হচ্ছে, খুব বেসিক একটা ওয়র্কশপ হয়ত আমি করিয়ে দিলাম। এছাড়া আমি এনএসএইচএম (NSHM)-এ এ ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি হিসেবে স্টেজ প্রোডাকশন এবং অ্যাক্টিং পড়াতাম। পড়ানোর সূত্রে হয়তো অনেক জায়গাতেই কিছু কাজ করেছি, কিন্তু একটা সম্পূর্ণ কাজে একজন অভিনেতাকে ওয়র্কশপ করিয়ে ওই জায়গাটায় নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা এখনও পর্যন্ত আমি করিনি। মাঝেমধ্যে কিছু প্রজেক্টে আমি বেণীকে অ্যাসিস্ট করি। একটা মানুষ এমনি কীরকম এবং চরিত্রটা করে সে কীরকম হয়ে উঠল দেখতে খুব মজা লাগে। আমার এই জার্নিটা দিয়ে যেতে বা অন্য কাউকে নিয়ে যেতে খুব মজা লাগে। এবারে কেউ অন্যরকম ভাবলে তার জায়গা থেকেও হয়ত খুব ঠিক। এটা মনে হতেই পারে ওয়র্কশপ বেঁধে দেয়। কিচ্ছু বলে দেওয়া না হলে তিনি হয়ত যে লেভেলে একটা জিনিস করতে পারতেন বা যেভাবে ভাবতে পারতেন সেখানে সত্যিই হয়ত তিনি একটা ঘেরাটোপের মধ্যে বাঁধা পড়ে যান। মতামতের জায়গা থেকে সেটাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমার মনে হয়, ওয়র্কশপ সবথেকে দরকার হয় কোনও একটা পিরিয়ড পিসে, যে পিরিয়ড সম্পর্কে আমার কোনও জ্ঞান নেই বা বিশেষ কোনও অ্যাক্সেন্টে বা পুতুলের মতো কোনও চরিত্র যদি হয় সেখানে, বা কোনও একটা বাদ্যযন্ত্র বাজাতে হবে যেটা বাজাতে আমি একেবারেই অভ্যস্ত নই। গাড়ি চালাতে হবে বা অটো চালাতে হবে, সেই ধরণের ক্ষেত্রে ওয়র্কশপ অবশ্যই প্রয়োজন। আজকে যদি তোমাকে অটোচালকের চরিত্র দেওয়া হয়, সেখানে সে কীভাবে টাকাটা নিয়ে ঢোকায়, কীভাবে গাড়ি থেকে নেমে প্যাসেঞ্জার ডাকে, সেই ব্যাপারটাই তুমি ওয়ার্কশপ ছাড়া করতে পারবে না। সে কীভাবে আয়না দেখে, কারণ গাড়ি আর অটো এক নয়। সে তো রিয়ার ভিউ মিররটাও অন্যভাবে দেখবে। এই পুরো ফিজিক্যালিটিটা চরিত্রটার মধ্যে না পেলে এক ঝলক দেখলেই বুঝতে পেরে যাব যে সে জীবনে অটো চালায় নি।

প্রশ্ন: লিখতে পারো। অভিনয় করছ। পরিচালনার ব্যাপারে কিছু ভেবেছ? শুরুতে নাটকের কথাই বলছি।

তানিকা: এটা আমাকে অনেকে জিজ্ঞাসা করে। যেহেতু তুমি শুরুতে নাটকের কথাটা জিজ্ঞাসা করছ, আমি বলব, নাটক হল মঞ্চ, আবহ, ব্যাকস্টেজ, আলো, অভিনয় সবটা নিয়ে। সমস্ত কিছু নিয়ে একটা হোলিস্টিক ধারণা থাকাটা খুব দরকার। সেটা আমার মনে হয় না এখনও পর্যন্ত আছে। তাই আমার কখনোই এটা মনে হয় না যে এখন নাটকের নির্দেশনা দেব। তবে আমি কোনও কিছুতেই না বলতে চাই না। কথাতেই আছে, ‘নেভার সে নেভার’। তাই আমি এটাও কখনও বলব না যে ভবিষ্যতে ছবিও পরিচালনা করব না। আমি সত্যিই জানি না কী হবে। হ্যাঁ, আমি এখনও রেডি নয়।
তবে আমার দেখতে খুব ভাল লাগে। আমি সবসময় মনিটরের পাশে ঘুরঘুর করি। এটা অঞ্জনদাও একবার আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। আমি যেহেতু মাস কমের ছাত্রী ছিলাম তাই আমার এই ব্যাপারে এমনিই একটা ইন্টারেস্ট রয়েছে। আমার ফ্রেমিংয়ের দিকে খুব ইন্টারেস্ট।ছবি তুলতে খুব ভালবাসি। ফিল্মমেকিংয়ের পুরো প্রসেসটাই আমার খুব ভাল লাগে। আর এখন এত ভাল ভাল পরিচালক রয়েছেন।

প্রশ্ন: তাও একটা নতুন প্রজন্মের তো দরকার!

তানিকা: হ্যাঁ, অবশ্যই একটা ফিমেল গেজ প্রয়োজন। যেটা আমি লেখার ক্ষেত্রেও মেন্টেইন করার চেষ্টা করি। যদি সেই জায়গা থেকে কখনও কিছু করার হয় তাহলে আমি নিশ্চয়ই করব।

প্রশ্ন: আচ্ছা, জানতাম না যে তুমি মাস-কম পড়েছ। কখনও সাংবাদিকতা করতে ইচ্ছা করেনি?

তানিকা: এটা খুব ইন্টারেষ্টিং ব্যাপার। আমি প্রেসিডেন্সি থেকে সোশিওলজি অনার্স নিয়ে গ্রাজুয়েশন করি। তারপরে যেটা হয়, সবাই বলে মাস্টার্স কর। কিন্তু আমার সোশিওলজি নিয়ে আর কিছু করার মতো খুব একটা ইচ্ছে ছিল না। খুব কঠিন মনে হচ্ছিল। আর এদিকে আমার অভিনয়ের প্রতি একটা ঝোঁক ছিল কিন্তু আমার বাবা আমাকে অভিনয় করতে অ্যালাও করছিল না। কারণ আমি একটা ভীষণ অ্যাকাডেমিক ফ্যামিলি থেকে এসেছি, যেখানে সবাই হয় প্রফেসর নয় টিচার। তাই বাধ্য হয়ে আমি একটা পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিপ্লোমা করি মাস কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজম নিয়ে। এবং খুব অদ্ভুতভাবে আমি কলেজে টপ করি। জানি না কী করে! তারপরে আমি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে একটা ইন্টার্নশিপ করি। সিএনএন থেকে আমি একটা ইন্টার্নশিপের অফার পাই। বিবিসি’তেও একটা ইন্টার্নশিপের অফার পাই, কিন্তু আমি করি না। আমি বুঝতে পারি এখানে এমন কিছু বিষয় আছে যেটা সত্যিই খুব কঠিন।

প্রশ্ন: কোথায় কঠিন?

তানিকা: অনেক কিছু পলিটিক্যাল ব্যাপারও রয়েছে, সেগুলো হয়ত খুব রিস্কি। তাছাড়া ততদিনে অভিনয়টাকেও আমি ভালবেসে করতে চাই। তখন আমি একটা টক্সিক রিলেশনশিপেও ছিলাম। আমার তখন যার সঙ্গে সম্পর্ক, সেও আমাকে অভিনয়টা করতে দিতে চাইত না। এই সমস্ত কিছু নিয়ে আমি খুব ঘেঁটে ছিলাম। আমি বাবাকে বললাম, দেখো আমার তোমার কাছে প্রমাণ করার ছিল, আমি প্রমাণ করে দিয়েছি। আমি কলেজে টপ করেছি, এতগুলো ইন্টার্নশিপ পাচ্ছি। কিন্তু আমি সেটা করতে চাইছি না। কারণ, এটা এতটাই দায়িত্বের ব্যাপার যে আমি সেটা নিয়ে ছড়াতে চাই না, তাই আমি সাংবাদিকতা করতে চাই না। আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে, ‘সাংবাদিকতা ইজ্ নট মাই কাপ অব টি’।অল ইন্ডিয়া রেডিওর ইন্টার্নশিপের পরে আমি একটা ব্রেক নিই। আমি ঠিক করি, আগে ভেবে দেখি যে আমি কী করতে চাই। ওই ব্রেকেই আমার বিশ্বরূপ স্যারের সঙ্গে দেখা হল। স্যারের একটা ওয়র্কশপ জয়েন করি। তখন আমি একটা সিদ্ধান্ত নিই। মা’ও আমাকে বলে, ঠিক আছে তুই ছ’মাসের সময় নে। তার মধ্যে যদি কিছু না হয় তখন কোনও একটা চাকরি জয়েন করবি। কতদিন বসে থাকবি!

প্রশ্ন: ভাল সিদ্ধান্ত।

তানিকা: ২০১৩ এর শেষের দিকে আমি বিশ্বরূপ স্যারের কোচিংয়ে ভর্তি হই। তারপর ২০১৪-র বেশ কিছুটা সময় পার হওয়ার পর আমি আস্তে আস্তে অডিশন দিতে শুরু করি। ওই বছরেই আমি স্যারের একটা সিনেমায় ছোট একটা চরিত্র করি। যিশুদার একটা সিরিয়ালে আমি অভিনয় করি। সিরিয়ালটা শুরু হয়ে যাওয়ার পরে আমার বাড়ির লোকের মনে হয়, যাক এ তাহলে কিছু একটা করতে পারবে। তারপরে আমাকে খুব একটা পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। আমি ভাবিইনি অন্য কিছু করব। আমি আমার মার্কশিটই কালেক্ট করেছি অনেক বছর পরে।

প্রশ্ন: সাংবাদিকতা তাহলে তানিকার কাছে ব্রাত্যই থাকল?

তানিকা: দেখো, প্রথমত আমি বুঝতে পেরেছিলাম এটা আমার দ্বারা হবে না। আরও একটা জিনিস যেটা হল, আমার মনে হল যে সাংবাদিকতা মানে সংবাদ মানে সত্যি। কিন্তু সাংবাদিকতা করতে গিয়ে আমি বুঝতে পারলাম সেখানে সবকিছু সত্যি নয়। এইটা বোঝার পরে আমার…

প্রশ্ন: মোহভঙ্গ হল…

তানিকা: …মোহভঙ্গই বলতে পারো। তখন আমি আমার বন্ধুদের বললাম যে আমরা না মাস-কমিউনিকেশনটা অন্যভাবে পড়ে এসেছি। আমাদের টিচাররা আসল সত্যিটা আমাদের বলেননি। আমি এই জিনিসটার মধ্যে থাকতে পারব না। হয় আমাকে এখানে লোকজন মেরে ফেলবে, নয়তো আমি নিজেই মরে যাব। তার মধ্যে আমার ক্রাইম জার্নালিজম করার ইচ্ছে ছিল। সেটা তো বাড়ি থেকে আরও বাধা দিয়েছে। মা বলেছে, একদম নয়। আমার দাদা সাংবাদিক। দাদাও আমাকে বোঝালো যে না এতটা সোজা নয়, এভাবে হবে না, তোকে লেগে থাকতে হবে। আর এইভাবে সত্যি সত্যি করে পিছনে ছুটলে তুই মরবি তাড়াতাড়ি।

প্রশ্ন: পুতুলে ফিরেই শেষ করি। পুতুল তোমার কাছে কী রেখে গেল?

তানিকা: আমি যদি আমার কেরিয়ারটা ধরি, তাহলে আমি দশ বছর ধরে অনুশীলনরত একজন অভিনেতা। একজন অভিনেতার অনুশীলন কখনও শেষ হয় না, সারাজীবন চলতেই থাকে। পুতুল এই প্রথম আমাকে এমন একটা জায়গায় স্বীকৃতি দিয়েছে যেটা এর আগের কোনও চরিত্র আমাকে দিতে পারেনি। পুতুল আমাকে এতটা ভালবাসা দিয়েছে যে আমি ভাবতে পারিনি মানুষ আমাকে এতটা ভালবাসতে পারে। তবে সবকিছুর বাইরে গিয়ে বলব, ২০২৪ সালে আমার জীবনে অনেক বাজে ঘটনা ঘটে। আমি অনেক কিছুর মধ্যে দিয়ে যাই। মুম্বইতে সেটল্ করার চেষ্টা করি। অডিশন দিই বিভিন্ন কাজে, কিছু হয়, কিছু হয় না। অ্যাডের অডিশনও দিই। কিছু হয়, কিছু হয় না। আমার খুব বাজে ভাবে সম্পর্কে বিচ্ছেদ হয় এবং সেটা মানসিকভাবে আমাকে প্রচন্ড ভেঙে দেয়। আমি মেন্টাল হেলথ্ নিয়ে অনেক জায়গাতে কথা বলি। আমি একজন মেন্টাল হেলথ্ অ্যাডভোকেট বলতে পারো। কিন্তু ২০২৪ সালটায় আমি নিজেই মেন্টালি খুব ডাউন ছিলাম। সেইখানে পুতুল আমাকে নতুন করে একটা বেঁচে থাকার রসদ জুগিয়েছে। আমাকে নতুন করে জীবনটা দেখিয়েছে। তাই সত্যিই আমি বলব, ‘চালচিত্র’ এবং পুতুল আমার বেঁচে থাকার নতুন একটা অ্যাভিনিউ খুলে দিয়েছে। এর বেশি কী চাওয়ার থাকে, এর বেশি কে চায়?

Loading


Share It