অঘোরীতন্ত্রের রহস্য নিয়ে এহসাসের তথ্যচিত্র, নিবেদনে তনুশ্রী
সোমনাথ লাহা
বিপুলা এ পৃথিবীর অনেক কিছু আজও রহস্যাবৃত। সাধু-সন্ন্যাসীদের পীঠস্থান এই ভারতেও রয়েছে এমন অনেক ঘটনা। লৌকিক এবং অলৌকিকের ঘেরাটোপে আজও যা রয়ে গিয়েছে অন্তরালেই। শুধু তাই নয়। অপব্যাখ্যা ও বিভ্রান্তির ঘেরাটোপে আবদ্ধ সাধারণ মানুষ তাই অনেক ক্ষেত্রেই আসল সত্যকে উপলব্ধি করতে অসমর্থ হয়েছেন।
হিন্দু সন্ন্যাসীদের অন্যতম একটি রহস্যময় গোষ্ঠী, অঘোরী। তাঁদের এক স্বতন্ত্র আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। অঘোর শব্দের অর্থ তপস্বী শৈব। অর্থাৎ শিবের উপাসনা করেন যাঁরা। আদিদেবের সৌজন্যেই এই সম্প্রদায়ের উৎপত্তি, এমনটাই বিশ্বাস করা হয়। শিবের উপাসক তথা শিব ভক্ত দত্তাত্রেয় ঋষিকে বলা হয় অঘোর শাস্ত্রের গুরু। প্রচলিত ধর্মীয় নিয়ম বিধির বাইরে বেরিয়ে আধ্যাত্মিক সাধনা করেন এই শাস্ত্রের নিয়ম মেনে চলা সাধুরা। সেই কারণেই এঁদের সাধনা, ভাবনা-চিন্তা, আচরণ সামাজিক লোকচক্ষুর অন্তরালেই থাকে। এইজন্যই তাঁরা গোপন ও অধরা একটি গোষ্ঠী।
শৈব উপাসক অঘোরীদের বাসভূমি শ্মশান। শরীরে ছাই মাখা, মৃত মানুষের মাথার খুলিকে পাত্র হিসেবে ব্যবহার করা এবং মানুষের মৃতদেহ থেকে মাংস খাওয়ার মতো বিষয় তাঁদের সাধনার সঙ্গে জড়িত। সমাজের প্রচলিত নিয়ম ও মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করে বরাবরই মানুষের সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে উঠে নিজেদের কার্য সম্পাদন করে থাকেন তাঁরা। কারণ তাঁদের আধ্যাত্মিক বিশ্বাস যে, তাঁরা হলেন শিবের অংশ তথা ‘শিবায়’। এভাবেই তাঁরা সমস্ত শক্তিকে নিজেদের মধ্যে সঞ্চারিত করেন।
অঘোরীদের নিয়ে সাধারণ মানুষের উৎসাহ চিরকালীন। সেই কারণেই তাঁদের জীবন ও দর্শন নিয়ে অনেক গবেষণা ও আলোচনা হয়েছে, যা ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু তারপরও অঘোরীদের সম্পর্কে অনেক বিভ্রান্তি জনমানসে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি তাঁদের বিষয়ে অনেক অপব্যাখ্যা, ভুল ধারণা তৈরি করা হয়েছে। এবার অঘোরতন্ত্রের রহস্যময় জীবনের নানাদিক এবং আসল সত্যটি উঠে আসতে চলেছে তথ্যচিত্রে। সেই কাজটিকেই দক্ষতার সঙ্গে করেছেন এক বঙ্গকন্যা, এহসাস কাঞ্জিলাল।
এহসাসের তৈরি তথ্যচিত্র ‘স্যাক্রেড স্কালস’ আসলে অঘোরীদের রহস্যময় জীবনচর্চা, আধ্যাত্মিকতার আসল সত্যকে উন্মোচিত করবে দর্শকদের সামনে। এটির মাধ্যমেই অঘোরীদের জীবনের সারসত্য ‘অহং ব্রহ্মাস্মি, তৎ ত্বং অসি’ -র অভ্যন্তরে প্রবেশ করার সুযোগ পাবেন দর্শকরা। তারই ঝলক উঠে এসেছে তথ্যচিত্রের টিজারেও। অঘোরী কন্ঠে ‘I’m Shiva, You’re Shiva’ যেন আমিই সেই পরম শক্তি, তুমিও সেই-এরই প্রকাশ।
ইতিমধ্যেই এশিয়ার বৃহত্তম লাল বাতি এলাকাকে নিয়ে এহসাসের তৈরি তথ্যচিত্র ‘রেড নটস’ রীতিমতো প্রশংসিত এবং সমাদৃত হয়েছে। এরপরই নিজের দ্বিতীয় তথ্যচিত্র ‘স্যাক্রেড স্কালস’-এর কাজে হাত দিয়েছেন এহসাস। এই তথ্যচিত্রটি এক অর্থে অঘোরী সাধুদের চারপাশের রহস্যের স্তরগুলিকে উন্মোচন করার পাশাপাশি তাঁদের জীবন, আচার-অনুষ্ঠান এবং দর্শনের গভীরে প্রবেশ করবে। তথ্যচিত্রর মধ্যে দিয়ে ভয় এবং শ্রদ্ধার, জীবন ও মৃত্যু, আধ্যাত্মিকতা এবং মানবতার চূড়ান্ত প্রশ্নের মুখোমুখি দর্শকদের দাঁড় করিয়ে দিতে চান পরিচালক।
আসলে পরিচালক ‘স্যাক্রেড স্কালস’-এর হাত ধরে সেই পৃথিবীর সন্ধানে নেমেছেন যেখানে পবিত্র ও নিষিদ্ধ উভয়েরই সহাবস্থান। প্রজ্ঞাম্যাটিক ফিল্মস ও মোজোটেল এন্টারটেইনমেন্টসের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত এই তথ্যচিত্রের প্রযোজক হলেন গৌরব ছাবরা ও সুমনা কাঞ্জিলাল। এহসাসের তথ্যচিত্র অঘোরী সম্প্রদায়ের সাধুদের রহস্যময় জীবনশৈলীর উপর অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ এবং শ্রদ্ধাশীল আলোকপাত।
তবে চমক রয়েছে অন্যত্র। এই তথ্যচিত্রের হাত ধরেই প্রথমবার প্রেজেন্টার তথা নিবেদক হচ্ছেন টলিপাড়ার অন্যতম পরিচিত অভিনেত্রী তনুশ্রী চক্রবর্তী। তাই ‘স্যাক্রেড স্কালস’-এর হাত ধরে এক নতুন পথচলার সূচনা করলেন অভিনেত্রী। ভাল একটি কাজের পাশে দাঁড়ালেন।

সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ হল তথ্যচিত্রের পোস্টার ও টিজার। উপস্থিত ছিলেন তনুশ্রী চক্রবর্তী সহ তথ্যচিত্রের পরিচালক এহসাস কাঞ্জিলাল, প্রযোজক সুমনা কাঞ্জিলাল, গৌরব ছাবরা, তথ্যচিত্রের গবেষক তথা অন্যতম সহযোগী অঞ্জনাভ রায়। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন নাট্যকার – পরিচালক অঞ্জন কাঞ্জিলাল, পরিচালক সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়, অর্জুন দত্ত, মিউজিশিয়ান তথা পরিচালক অভিষেক বসু, চিত্রগ্রাহক মধুরা পালিত, অভিনেতা অনুভব কাঞ্জিলাল, অনুষ্কা চক্রবর্তী সহ বহু বিশিষ্ট মানুষজন।
অঘোরীর মতো একটি বিস্তৃত বিষয় নিয়ে কাজ করার আগে দীর্ঘ এক বছর ধরে এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ ও প্রিপ্রোডাকশনের কাজ সেরেছেন পরিচালক ও তাঁর টিম। রিসার্চের পুরোটাই সামলেছেন এহসাস ও তাঁর সহযোগী অঞ্জনাভ। পাশাপাশি এটির ঐতিহাসিক বিষয়গুলি ও টেকনিক্যাল দিকটিও সামলেছেন অঞ্জনাভ।
রেকি পর্বে একজন অঘোরী সাধুর সঙ্গে সঙ্গে দেখা করে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পরিচালক। এবার পরিচালক ও তাঁর টিম শুটিং করবেন প্রয়াগরাজে হওয়া মহাকুম্ভ( বিগত ১২ বছর পর যা হতে চলেছে) ও শাহিস্নান সহ বেনারস, দেবপ্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ, কামাখ্যা এবং গঙ্গাসাগরে। জুন অবধি শুটিংয়ের পরিকল্পনা রয়েছে পরিচালকের। আগামীদিনে তথ্যচিত্রটি বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে এহসাসের।
প্রথমবার প্রেজেন্টার হিসেবে এই তথ্যচিত্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে তনুশ্রী বলেন, “আমি পন্ডিত পরিবারের মেয়ে। আমার দাদু সংস্কৃত পন্ডিত ছিলেন। এই বিষয়ে দাদু প্রচুর পড়াশোনা করতেন। দাদুর কাছে বিভিন্ন শিষ্যরা আসতেন। এছাড়াও অনেক সাধু সন্ন্যাসীও আসতেন। অনেকেই আবার দাদুর বন্ধু ছিলেন। আমি ছোটোবেলায় তাঁদের দেখেছি। আমরা ‘লাল কাপড় পরা দাদু’ বলতাম। অঘোরী সাধুদের নিয়ে কাজের বিষয়টি সুবিশাল। তাই আমাকে যখন এটা প্রেজেন্ট করতে বলা হল সেখান থেকেই একটা আগ্রহ জন্মাল। তন্ত্র একটা জ্ঞান। তবে তন্ত্র সাধনার বিষয়টি নিয়ে অনেকরকম ভুল ব্যাখ্যা করা হয়। সত্যি বলতে আমার এই বিষয়ে জ্ঞান অনেক কম। বিভিন্ন আলোচনা, ফিল্মের বিষয়, যেখানে কালাজাদু, তন্ত্র সাধনার উল্লেখ রয়েছে সেখান থেকে জেনেছি। অঘোরী সাধুদের নিয়ে কাজ হলেও সেখানে ওদের সম্পর্কে অনেক বিভ্রান্তি, ভুল ধারণা তৈরি করে মানুষের সামনে ধরা হয়েছে। এহসাসের মতো একজন অল্পবয়সী বাঙালি মেয়ে এরকম একটা বিস্তৃত বিষয় নিয়ে কাজ করতে যাচ্ছে, কুম্ভমেলায় শুটিং করতে চলেছে এটা খুব ইন্টারেস্টিং এবং এক কথায় ভিস্যুয়ালি সিনেম্যাটিক ও উত্তেজনাময় বিষয় হতে চলেছে। তাই আমি এটা প্রেজেন্ট করতে রাজি হয়েছি।”
পাশাপাশি বেনারস ও কামাখ্যায় তনুশ্রী অঘোরী সাধুদের মুখোমুখি হয়েছেন সেকথা জানাতে ভোলেননি। অভিনেত্রীর কথায়, “আমি ঘুরতে ভীষণ ভালোবাসি। সেই সুবাদে কামাখ্যায়, বেনারসের ঘাটে সন্ধ্যারতির সময় অঘোরী সাধুদের দেখেছি। তবে ব্যক্তিগতভাবে কথাবার্তা বলা হয়নি।”
তথ্যচিত্র প্রসঙ্গে এহসাস জানান, “একবছর আগে মায়ের সঙ্গে কথাবার্তা প্রসঙ্গে অঘোরীর বিষয়টা উঠে আসে। এটা খুবই ইন্টারেস্টিং বিষয়। কিন্তু মা বলেন যে এটা খুব ভাল বিষয় হলেও রিসার্চের কাজটা ভাল হওয়া দরকার। শুটিংয়ের সময় আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি অঘোরীরা কতটা শিক্ষিত। অথচ ওদেরকে নিয়ে বিভিন্ন বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হয়েছে। ওঁরা সচেতনভাবেই নিজেদের বিশ্বাসকে নিয়ে ওই জায়গায় বিরাজ করেন। ওদের একটা আধ্যাত্মিক বিশ্বাস রয়েছে যে ওঁরা হচ্ছেন শিবায়। সেটাই তাঁদের শক্তি। আমি সুনির্দিষ্টভাবে এটা তৈরি করছি কারণ এই আসল সত্যিটাকে সকলের সামনে তুলে ধরতে চাই। প্রত্যেকটি মুদ্রার দুটো পিঠ থাকে। অঘোরীদের নিয়ে ইতিপূর্বে যে কাজগুলো হয়েছে তাতে অনেক কিছুই ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আমরা অঘোরীদের নিয়ে কোনও থ্রিলার নির্মাণ করছি না। শুধু সত্যিটাকে তুলে ধরতে চাইছি।”
তথ্যচিত্রটির অন্যতম গবেষক অঞ্জনাভ রায়ের মতে, “আমরা মূলত ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অন্যরকম বিষয় ভাবনাগুলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। অঘোরীদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমাদের প্রথমেই যেদিকে আলোকপাত করতে হয়েছে যে অঘোরী কিভাবে তৈরি হল! তাঁদের কাছে শিবায় হলো অসীমতম শক্তি। শক্তি কখনও ইতিবাচক বা নেতিবাচক হতে পারে না। সেটা নির্ভর করে কিভাবে সেটাকে ব্যবহার করা হচ্ছে তার উপর। ভৌগলিক স্থান-কাল-পাত্র বিশেষে কিছু জিনিস অঘোরীদের মধ্যে দেখতে পাই। বদ্রীনাথের অঘোরীদের শিবকে দেখা এবং কামাখ্যার অঘোরীদের মধ্যে শিবকে দেখার মধ্যে তফাৎ রয়েছে। ওঁরা নাকি মৃত মানুষের রক্ত-মাংস খায়…এমন কথা বলা হয়। আসলে ওরা সমস্ত শক্তিকে নিজেদের মধ্যে সঞ্চারিত করে। আমাদের ডকুমেন্টারির টিজারের শুরুটাও সেখান থেকেই হয়।”
তথ্যচিত্রের অন্যতম প্রযোজক গৌরব ছাবরার কথায়, “আমি সবসয়ই ভাল বিষয় ভাবনা নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। আমি ভীষণ আনন্দিত এহসাসের মতো প্রতিভাবান পরিচালক ও তাঁর টিমের সঙ্গে কাজ করতে পেরে। এই বিষয়টা নিয়ে আমাদের মধ্যে কথাবার্তা হয়েছিল। আমি এই টিজারটি দেখে রীতিমতো মুগ্ধ হয়েছি। এহসাসকে ধন্যবাদ আমাকে এরকম সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য। আমি একজন সাধারণ মানুষ। অঘোরীদের নিয়ে আমার মধ্যেও অনেক বিষয়ে বিভ্রান্তি ছিল। কিন্তু এর মধ্যে এরকম ইতিবাচক দিক থাকতে পারে সেটা আমি জানতাম না। আশা করছি প্রজ্ঞাম্যাটিক ফিল্মসের এই প্রথম কাজটা অন্যরকম হতে চলেছে। খুব ভাল একটা বিষয় আমরা সকলকে উপহার দিতে পারব।”
সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ এহসাস এবার ‘স্যাক্রেড স্কালস’-এর মাধ্যমে অঘোরীদের জীবন ও তাঁদের বিশ্বাসভাবনার দিকগুলির প্রতি নিরন্তর অন্বেষণ চালিয়ে সেই প্রতিচ্ছবি দর্শকদের সামনে হাজির করতে চলেছেন। এমন বিষয়ভাবনা নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্রের প্রতি যে দর্শক ও সিনেপ্রেমীদের উৎসাহ থাকবে তা বলাই বাহুল্য।