পেশীশক্তি ও রাজনৈতিক যোগসাজশেই অবলুপ্ত শতাব্দী প্রাচীন মন্মথ কেবিন!

Share It

সুকুমার রক্ষিত

একটা পুরনো কথা লিখি। যে ছবিটা দেখছেন, সেটা উত্তর কলকাতার এক অতি প্রাচীন চায়ের দোকান কাম আড্ডার ঠেক, ‘মন্মথ কেবিন’। এখন তো লোকে এসবকিছুকে ‘ক্যাফে’ নামে ডাকে! শ্যামবাজার ট্রাম ডিপোর ঠিক উল্টোদিকে বিধান সরণীর ওপরেই। ঠিকানা, ৯৯ এ বিধান সরণী। এর অবস্থান। এই কেবিনের ঠিক ওপরেই এককালে ছিল কুমিল্লা ব্যাঙ্কের শাখা, যেখানে রবীন্দ্রনাথেরও একটা অ্যাকাউন্ট ছিল। কখনও সখনও কাজেকর্মে ব্যাঙ্কে এলে নীচের ওই কেবিনে দুদণ্ড বসতেন। পরবর্তীকালে শিবদাস ভাদুড়ি, বিজয়দাস ভাদুড়ি, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সুঁটে বন্দ্যোপাধ্যায়, পঙ্কজ রায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, অনেকেই আড্ডা জমাতে আসতেন। এতই প্রাচীন এই কেবিনের ইতিহাস। এককথায় একটা হেরিটেজ কেবিন।

কিন্তু, দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, বাঙালি নিজেদের ঐতিহ্য ও মর্যাদা বহন করতে পারে না। তাই এই কেবিনটাও অবলুপ্ত হয়ে গেছে। না, কালের নিয়মে নয়। গায়ের জোরে এক বিধবার কাছ থেকে কেবিনটা দখল করে এক সোনার দোকানের মধ্যে আত্মসাৎ করে নেওয়া হয়েছে।

বিষয়টা একটু খুলে বলা যাক। মন্মথ কেবিনের মালিক ছিলেন অশোক কুমার নন্দী। কোভিডের সময়ে তিনি দোকান বন্ধ রেখেছিলেন। সত্তরোর্ধ অশোকবাবু ছিলেন নিঃসন্তান। স্ত্রী পৃথা নন্দীও বৃদ্ধা ও অসুস্থ। এই দম্পতি কেবিন চালিয়েই কোনওক্রমে দিনগুজরান করতেন। অশোকবাবু এবং তাঁর বোন অন্নপূর্ণাই ছিলেন ওই বাড়ির মালিক। কোভিডের সময়ে অশোকবাবুর পরপর কয়েকবার হার্ট অ্যাটাক হয় এবং ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি প্রয়াত হন।

এর পরেই শুরু হয় খেলা। ওই বাড়িতেই একটি ছোট্ট দোকানঘর নিয়ে এক ব্যক্তি সোনার ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তিনি আদতে বাংলাদেশের বাসিন্দা এবং ২০১৫ নাগাদ এই দেশে ঢুকেছেন। তার পর থেকে তিনি নানা কায়দায় সোনারূপার ব্যবসা শুরু করে দেন। পৃথা নন্দীর অসুস্থতা ও অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ওই ভাড়াটিয়া ষড়যন্ত্র করে মন্মথ কেবিন গায়ের জোরে দখল করে, ভেঙে গুঁড়িয়ে নিজের দোকানের মধ্যে আত্মস্থ করে। অদ্বিতীয়া জুয়েলার্স নামে ওই দোকানটা (ছবিতে আছে) আসলে তিনটে দোকানের সমষ্টি। এর আগে ওই ভদ্রলোক পাশের আরেকটা দোকান ভাড়া নিয়ে গার্ডওয়াল ভেঙে নিজের দোকানে ঢুকিয়ে নিয়েছিলেন। সেই নিয়ে এখনও মামলা চলছে।

পৃথা নন্দীকে ভয় দেখিয়ে গায়ের জোরে মন্মথ কেবিনও দখল করলেন। পৃথাদেবী কলকাতা পুলিশের কাছে সহায়তা চান, এফআইআরও হয়। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সবটা জানা ও বোঝা সত্ত্বেও পুলিশ এখনও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। কলকাতা পুরসভা বেআইনি কনস্ট্রাকশনের কীভাবে অনুমতি দিল জানতে চেয়েও পৃথাদেবী মামলা করেছেন।পেশীশক্তি ও রাজনৈতিক যোগসাজশেই কি শতাব্দী প্রাচীন মন্মথ কেবিন অবলুপ্ত হল? উত্তর দেবে সময়।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

Loading


Share It