জাতপাতের বৈষম্য পেরিয়ে দুই নারীর ভালবাসার কাহিনি ‘উইডো’স শ্যাডো’
সোমনাথ লাহা
আধুনিক সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশ অগ্রগতির পথে এগিয়ে চলেছে। তারপরও ভারতের প্রত্যন্ত বিভিন্ন অঞ্চল এখনও সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। উন্নয়ন, অগ্রগতির ছিটেফোঁটাও সেখানে যেমন পৌঁছায়নি, তেমনই মানসিকতার দিক থেকেও পিছিয়ে রয়েছেন তাঁরা। আজও জাতপাতের বৈষম্য, বিধিনিষেধের গণ্ডিতে আবদ্ধ রয়েছেন দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। সেই প্রেক্ষাপটেই এক অন্যরকমের কাহিনির বুনন সেলুলয়েডে ঘটিয়েছেন পরিচালক সুমন অধিকারী।
নিজের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবির জন্য গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে এসে অন্যরকম বিষয় ভাবনাকেই বেছে নিয়েছেন পরিচালক। তাঁর পরিচালিত হিন্দি ছবির ‘উইডো’স শ্যাডো’ মুক্তি পাচ্ছে ১৮ এপ্রিল। ছবির বিষয় ভাবনা জুড়ে রয়েছে জাতপাতের বৈষম্য, বিধিনিষেধের গণ্ডি পেরিয়ে দুই নারীর পারস্পরিক সম্পর্ক, ভালবাসার গল্প। সমপ্রেম বা সমকামিতার মতো বিষয়কে নিয়েই নিজের প্রথম ছবির নির্মাণ করেছেন সুমন। প্রসঙ্গত দীর্ঘ আট বছর ধরে মুম্বই নিবাসী হলেও সুমনের শিকড় এই বাংলা।

একসময় ‘গল্প হলেও সত্যি’ নাটকের পরিচালনা দিয়ে সুমনের পথচলা শুরু। পরবর্তী সময়ে তাঁর হাত থেকে বেরিয়েছে বেশ কিছু স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি। সেই তালিকায় রয়েছে ‘রান্নাবুড়ি’, ‘বছর তিরিশ পর’-এর মতো ছবি। সেই শর্ট ফিল্মগুলো রীতিমতো প্রশংসিত ও সমাদৃত হয়েছে দেশবিদেশের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে। এখানেই শেষ নয়। কোভিড পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সুমনের তৈরি ‘ফির হাত মিলায়েঙ্গে’ মিউজিক ভিডিওটিও বেশ প্রশংসিত হয়েছে।
তবে নিজের প্রথম ছবিতে দুই ভিন্ন সামাজিক অবস্থান থেকে আসা নারীর গল্পকে পর্দায় মেলে ধরেছেন সুমন। কমবয়সী দুই নারীর একজন ব্রাহ্মণ পরিবারের। অল্প বয়সে বিধবা হওয়ার কারণে পরিবার তাকে পাঠিয়ে দিয়েছে বিধবা আশ্রমে। অপরদিকে রয়েছে ডোম পরিবারের স্বামী দ্বারা অত্যাচারিত একটি মেয়ে। এই দুটি মেয়ের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেছে শ্মশান। জীবনের পরিসমাপ্তি যেখানে ঘটে সেখান থেকেই দুই নারীর সম্পর্ক গড়ে উঠছে। ছবিতে প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষের কথার পাশাপাশি সামাজিক বিধিনিষেধের উর্ধ্বে ওঠা ভালবাসার চিত্রও মেলে ধরেছেন পরিচালক।
কাজল পরলে চোখের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। আর চোখেই নারী কাজল পরে। কিন্তু যখন সেই চোখ জলে ভরে ওঠে, কাজলের শোভা নষ্ট হয়ে ঘেঁটে যায়। কাহিনির বুননে এমনই ছবি সেলুলয়েডে এঁকেছেন পরিচালক সুমন অধিকারী। তাই ছোট্ট করে একবার গল্পের অন্দরে প্রবেশ করা যাক। ব্রাক্ষণ পরিবারের মেয়ে আঁখি তার স্বামীকে হারানোর পর তাকে বলা হয় বিধবা আশ্রমে চলে যাওয়ার জন্য। কারণ বাড়িতে তার বোনের বিয়ে। আশ্রমে যাওয়ার পর কাজলের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। কাজল ডোম। সে তখনও বিধবা নয়। স্বামীর হাতে অত্যাচারিত। কিন্তু কীভাবে কাজল ডোম হয়ে উঠল? তার নেপথ্যেও রয়েছে কাহিনি। শ্মশানে এই দুই নারীর দেখা হয়। ক্রমশ এই দুই নারীর মধ্যে পরিচয় নিবিড় হয়ে ওঠে। কারণ ঘটনাচক্রে, আঁখিকে বাঁচায় কাজল। ধীরে ধীরে শ্মশানের নির্জনতায় সময় কাটাতে কাটাতে তাদের বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয়। ক্রমশ এই দুই নারীর মধ্যেকার রসায়ন এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যেটি লিঙ্গ নিরপেক্ষ। দুটি নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ের এহেন সমপ্রেম, ভাললাগার ফলে তৈরি হয় সমস্যা। কারণ, রাজস্থানের উদয়পুরের যে অঞ্চলে তাদের বসবাস সেখানে জাতপাতের বৈষম্য ঘোরতর। বিধিনিষেধের গণ্ডির আবহ এতটাই প্রকট যে তা লঙ্ঘন করার সাহস তথা সাধ্যি কারও নেই। ফলস্বরূপ রীতিমতো প্রতিকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায় এই দুই নারীর জীবনযাপন। তারপর কী হয়! কোন খাতে বইবে আঁখি ও কাজলের জীবন। সেই উত্তর জানতে ছবির পর্দায় চোখ রাখতে হবে।

ছবিটির শুটিং হয়েছে উদয়পুর ও তার আশেপাশের বিভিন্ন জায়গায়। যদিও পরিচালক চেয়েছিলেন বেনারসেই ছবির শুটিং করতে। কিন্তু বিভিন্ন সমস্যা ও পরিস্থিতিগত কারণেই উদয়পুরকেই বেছে নিয়েছেন পরিচালক। ছবিতে প্রধান চরিত্রের অন্যতম কাজলের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সংকলিতা রায়। পরিচালকের মতোই তাঁরও রয়েছে বাংলা যোগসূত্র। একসময় প্রভাত রায়ের ছবি ‘হ্যাংওভার’-এর হাত ধরেই সিনে আঙিনায় পা রেখেছিলেন সংকলিতা। তারপর কেটে গিয়েছে অনেকটা সময়। সংকলিতাও এখন মুম্বইতেই থাকেন। ছবির কাহিনিও তাঁর লেখা।
ছবিতে আঁখির চরিত্রে অভিনয় করেছেন পলক কায়াথ। দীর্ঘদিন থিয়েটারের পাশাপাশি বেশ কিছু শর্ট ফিল্মেও কাজ করেছেন। অডিশনের মাধ্যমে এই চরিত্রের জন্য তাঁকে বেছে নিয়েছেন পরিচালক। ছবিতে সংকলিতা ও পলক ছাড়াও অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন পৃথ্বীরাজ দেশাই, অবনী নাগর, পল্লবী ভাট, নন্দিতা পুরোহিত প্রমুখ। ছবিতে রয়েছে তিনটি গান। ছবির ‘কাহানি’ গানটি গেয়েছেন রিচা শর্মা। ‘রুহ’ গানটি গেয়েছেন কবিতা শেঠ। ‘পাধারো’ গানটি গেয়েছেন শুভা মুদগল। ছবির গানগুলির গীতিকার ও সুরকার পরিচালক সুমন স্বয়ং। ছবির সিনেমাটোগ্রাফার শুভায়ু চক্রবর্তী। সম্পাদনায় জয়জিৎ সরকার। সুবীর দত্ত প্রোডাকশন্স, লাইন প্রোডিউসার’স ইন্ডিয়া অ্যান্ড ফিক্সারস ও র্যাট রেস ফ্রেমসের ব্যানারে নির্মিত এই ছবিটির প্রযোজনা করেছেন সুবীর দত্ত, শুভম নাগরের সঙ্গে সংকলিতা রায় ও পরিচালক নিজেই। তবে এই ছবিটির সেন্সরের ছাড়পত্র আদায় করতে রীতিমতো বেগ পেতে হয়েছে পরিচালককে। অবশেষে ‘এ’ সার্টিফিকেট পেয়েছে ছবিটি।
সম্প্রতি ছবির প্রচার উপলক্ষে কলকাতায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ছবির পরিচালক, প্রযোজক সহ কলাকুশলীরা। প্রযোজক সুবীর দত্তের কথায়, “এই ছবিটির বিষয় ভাবনা যেমন অন্যরকমের, তেমনই ছবির বিষয়বস্তু যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক এই সময়ে দাঁড়িয়ে। আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি একটা ভাল ছবি তৈরি করার। আমার বিশ্বাস এই ছবির কাহিনি বিশেষ শ্রেণীর দর্শকদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মনকেও ছুঁয়ে যাবে।”

ছবির কাহিনিকার তথা অন্যতম অভিনেত্রী সংকলিতার মতে, “আমাদের প্রযোজনা সংস্থা এবং শিল্পী তালিকায় সে অর্থে বড় নাম না থাকার পরও যেভাবে এই প্রজেক্টটিকে নিয়ে আমরা আজকে রিলিজের দোড়গোড়ায় এসে পৌঁছেছি সেই অনুভূতিটাই অন্যরকমের। এটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আমি অধীর আগ্রহে ছবিটি মুক্তির জন্য অপেক্ষা করছি।” গল্পটি লেখার প্রসঙ্গে অভিনেত্রী বলেন, “পরিচালকের থেকে শুধুমাত্র একটা লাইন পেয়েছিলাম।শ্মশানকে কেন্দ্র করে দু’জন বিধবার মধ্যে একটা ভালবাসার গল্প। শ্মশানকে কেন্দ্র করেই তাই আমরা শুটিং করতে চাইছিলাম। কারণ চরিত্র দু’জন শ্মশানের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই ভাবনাটিকে নিয়েই আমি এই গল্পটি লিখতে শুরু করি।” ছবিতে প্রথমে আঁখির চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল সংকলিতার। কিন্তু কাজলের চরিত্রে সেভাবে অভিনেত্রী না পাওয়ায় সংকলিতা কাজলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
পলকের কথায়, “এই চরিত্রটা শুনেই আমি কাজটা করতে আকৃষ্ট হয়েছিলাম। অনেকেই জিজ্ঞেস করেছেন কাজটা করে আপনার কেমন লেগেছে? আসলে এই কাজটি করতে গিয়ে অনেক রকম চ্যালেঞ্জ, প্রতিবন্ধকতা পেরোতে হয়েছে। তারপর কাজটা করতে গিয়ে ঐ প্রেক্ষাপটে বা আরও ভাল করে বললে ওই জোনে প্রবেশ করতে হয়েছে। আমি তারপর ধীরে ধীরে চরিত্রে প্রবেশ করে গিয়েছিলাম। তারপর এখন যখন মানুষজন জানতে চাইছেন তখন আমার কাজের সময়ের অভিজ্ঞতাগুলোর কথা মনে পড়ে। সেটা মনে হলেই একটা আলাদা আনন্দ হয়। চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজটা এভাবে করতে পেরেছি সেটা ভেবে ভাল লাগছে।”
পরিচালক সুমন অধিকারী জানান, “আমি যখন এই ছবিটা করব বলে ঠিক করি তখন আমি একটা গল্পকে দর্শকদের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছি। কারণ, আমার কাছে গল্পটাই আসল। ছবিটা ২০২৪-এ মুক্তির কথা থাকলেও সেন্সর বোর্ডের গড়িমসির কারণেই ছাড়পত্র পেতে পেতে ২০২৫ হয়ে গেল। এই গল্পটা নিয়ে আমি যখন ছবির তৈরি করতে শুরু করি, শুরু থেকেই একটা ভাবনা মাথায় ছিল। ছবিটা খুব সুন্দর করে তৈরি করতে হবে। এই ছবি নিয়ে আমার যে প্রত্যাশা ছিল, তার থেকে অনেকটাই বেশি পেয়েছি।” সুমন আরও বলেন, “আমি এখনকার ছবির খুব একটা বেশি দেখি না। কিছু বাছাই করা ছবিই দেখি। কারণ, এখনকার ছবিতে সবকিছু থাকে, স্টারেদের মুখও দেখতে পাই কিন্তু গল্প পাই না। গল্প ছাড়া ছবিতে সবকিছুই থাকে। সেই কারণেই আমি এই ছবিতে গল্পটাকেই প্রাধান্য দিয়ে তুলে ধরতে চেয়েছি। সেইজন্য কোনও স্টার খুঁজিনি। অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করেছি। আমি সবসময়ই নতুনদের নিয়ে কাজ করতে ভালবাসি। সেজন্য এই ছবিতে আমি কোনও আড়ম্বর রাখিনি। একদম র’ গল্পটাই বলেছি।”

গল্প প্রসঙ্গে পরিচালকের বক্তব্য, “এই গল্পটা এমনই যেটা কোনও না কোনও জায়গায় হয়ে চলেছে। আমরা সেটাকে মেলে ধরতে পারছি না। এটাই হচ্ছে বিষয়।” কিন্তু দর্শক এই গল্পটাকে কিভাবে দেখবে তার উত্তরে পরিচালক বলেন, “সেটা তো দর্শকদের উপরে নির্ভর করছে। তবে ছবি তৈরির ক্ষেত্রে আমি সবসময়ই গতানুগতিকতার বাইরে চলতে পছন্দ করি। সেক্ষেত্রে দশজন দর্শক আমার ছবির দেখতে এলেও তাদের মধ্যে একজন মানুষের কাছেও যদি ছবিটা পৌঁছায়, তিনি মনে করেন একটা কিছু দেখলাম, সেখানেই আমার কাজের স্বার্থকতা। আমি যদি গল্পটাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারি তার থেকে বড় আর কিছুই হতে পারে না।”