‘ছবি দেখানোর খরচ কমল, দেখার খরচে খিঁচ’, কী বলছে ইন্ডাস্ট্রি?
ইস্টার্ন ইন্ডিয়া মোশন পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশন (EIMPA) – এর উদ্যোগে বাংলা ছবির ডিজিটাল প্রজেকশনের সার্বিক খরচ কমল। সাত দিনের মধ্যে প্রথমে ইউএফও (UFO) এবং কিউব (QUBE) প্রজেকশনের খরচ জিএসটি ছাড়া দিনে ১০০০ টাকা থেকে কমিয়ে ৩০০ টাকায় নিয়ে এল।

এতদিন বাংলা ছবির প্রযোজকদের ডিজিটাল প্রজেকশনের জন্য সবথেকে বেশি টাকা দিতে হত। এমনকী পশ্চিমবঙ্গের সিনেমাহলেও হিন্দি ছবি বা অন্য ভাষার ছবির ডিজিটাল প্রজেকশনের চার্জ বাংলা ছবির থেকে কম ছিল। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ইউএফও এবং কিউব-এর প্রজেকশনের সাপ্তাহিক চার্জ ৭০০০ টাকা থেকে কমিয়ে ২১০০ টাকা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। প্রসঙ্গত, ২০১০ এর দশকের শুরুর দিক থেকেই প্রযোজনা সংস্থা এসভিএফ কিউব-এর ফ্র্যাঞ্চাইজ হিসেবে রয়েছে।
প্রজেকশন চার্জ কমায় কতটা অক্সিজেন পেল ইন্ডাস্ট্রি? দ্য কাউন্টার কালচার-এর প্রশ্নের উত্তরে ইস্টার্ন ইন্ডিয়া মোশন পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি পিয়া সেনগুপ্ত বলেন, “পনের বছর ধরে আমরা একটা সর্বভারতীয় রেটের জন্য লড়াই করেছি। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আজকে কিন্তু গর্ব করে বলতে পারি যে সারা দেশে যা রেট আছে তার থেকে আমাদের রেট কম। এখন হিন্দি ছবির রেট যেখানে ৪২৫ টাকা, বাংলা ছবির সেখানে ৩০০ টাকা। দ্বিতীয় সপ্তাহে সর্বভারতীয় রেট যেখানে ৩৫০ টাকা, আমাদের সেখানে ৩০০ টাকা। প্রযোজকরা অনেকটা লাভবান হলেন। তাঁদের বাজেট কমে গেল, ছবি চালানোর খরচও কমল। ইন্ডাস্ট্রির কাছে এটা তো অক্সিজেন বটেই।”

পরিবেশক-প্রযোজক এবং এসএসআর সিনেমার কর্ণধার শতদীপ সাহা প্রজেকশন খরচ কমানোর জন্য ইম্পাকে সাধুবাদ জানান। একইসঙ্গে কিউব আর ইউএফও চাপে পড়েই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেও মত তাঁর। শতদীপের কথায়, “আমরা তিন বছর আগে কে সেরা সেরা (K Sera Sera) নামে একটি প্রজেকশন সিস্টেম চালু করি। পূর্ব-ভারতে আমরাই প্রথম সব থেকে কম প্রজেকশন খরচে ছবি দেখানো শুরু করি। বর্তমানে ২২টি সিনেমাহলে আমাদের প্রজেকশন চলছে। আজকে যে খরচটা কমল সেটা ইন্ডাস্ট্রির জন্য সত্যিই খুব ভাল। কিন্তু খরচটা কমানো হল একদমই একটা পরোক্ষ চাপের মুখে পড়ে। বর্তমানে এরকম অনেক জায়গা আছে যেখানে ইউএফও এবং কিউবের মেশিন খুলে আমাদের নতুন মেশিন লাগছে। ওদের মেশিন খুলে দিচ্ছে কারণ আমি প্রত্যেককে নতুন মেশিন দিচ্ছি আর ওরা পুরনো মেশিনকে ‘রিফারবিশ’ করে দিচ্ছে। আমার সিস্টেমে রেটটা অনেকটাই কম তাই অনেকেই আমার থেকে নিয়ে সেটা লাগাচ্ছিল। এর আগে বহু বছর ধরে বলে বলেও রেট কমাতে পারিনি তাই আমি একটা কম্পিটিটিভ মেশিন নিয়ে এসেছি যাতে প্রযোজকের দুটো পয়সা বাঁচে। আমি বলব এক্ষেত্রে হল মালিকদেরও সুবিধা হল। আমি যা পদক্ষেপ নেব সেটা ইন্ডাস্ট্রির ভালর কথা ভেবে কিন্তু এখন যেহেতু ওদের অনেকগুলো মেশিন নেমে যাচ্ছে তাই পলিটিক্স করে ওরা আমার রেটে নেমে এল।”
বর্ষীয়ান প্রযোজক এবং অরোরা ফিল্ম কর্পোরেশনের কর্ণধার অঞ্জন বসুর মতে, “প্রজেকশন চার্জ কমার ফলে নিশ্চয়ই একটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হচ্ছে কারণ আমাদের খরট অনেকটাই কমবে। এন্টারটেইনমেন্ট মানুষ যদি নেয় তবেই সেটা হিট, নাহলে ফ্লপ। সেক্ষেত্রে মানুষ কি বেশি দেখবার সুযোগ পাবে? টিকিটের দামটা কি কমবে?”
টিকিটের দাম কমানোর প্রসঙ্গে পিয়া বলেন, “চার্জ কমানোর জন্য এত লড়াই কিন্তু প্রযোজকদের বাঁচানোর তাগিদে। এখন যদি আমি আবার দর্শকের পকেটের চাপ কমাতে যাই তাহলে কিন্তু ঘুরে ফিরে গিয়ে প্রযোজকদের পকেটই হালকা হয়ে যাবে। টিকিটের দাম যদি কমানো হয়, প্রযোজকদের রেভিনিউ কমে যাবে। তাঁরা তাহলে সিনেমাটা বানাবেন কিভাবে?”

এক্ষেত্রে অবশ্য অঞ্জনের বক্তব্য, “বর্তমানে প্রযোজক, পরিবেশক, হলমালিক সবাই আলাদা আলাদা হয়ে গেছে। এইটা করলে খুব মুশকিল। কেউ তো কারো শত্রু নয়। সবাই মিলেই একটা ইন্ডাস্ট্রি তাই তাঁদের একসঙ্গে বসে একটা সুরাহা করতে হবে। প্রয়োজনে বাংলা ছবির টিকিটের দাম কমাতে পারলে আখেরে ইন্ডাস্ট্রির আরও বেশি লাভ। একজন অর্থবান আর একজন যদি অভাবী হয় তাতে লাভ হয় না। তাই সবাই মিলে আলোচনা করে আমরা যদি দর্শককে হলে টেনে আনতে পারি তাহলে সেইটাই হবে ঠিক মত কাজ। আপাতত যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেটা প্রযোজক বা হলমালিকদের জন্য ভাল। কিন্তু আমার মতে এই মুহূর্তে বাংলা ছবিতে দর্শকের লাভের কথা আগে ভাবতে হবে। যাঁদের জন্য আমরা ছবি করছি তাঁদের কাছে এই লাভটা পৌঁছে দিতে হবে। তাই আমার প্রস্তাব থাকবে যে অন্ততপক্ষে বাংলা ছবির ক্ষেত্রে যদি টিকিটের মূল্য নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা যায় তাহলে আমরা আরেকটুখানি এগিয়ে যেতে পারব।”
তবে টিকিটের দাম কমানোর ব্যাপারে একেবারেই সহমত নন শতদীপ। তাঁর মতে, “সাধারণ মানুষের এর সঙ্গে কোন লেনদেন নেই। প্রযোজক না বাঁচলে ছবিটা সে বানাবে কী করে? হল মালিকরা যে একটার পর একটা হল বন্ধ করে দিচ্ছিলেন তার মূল কারণ কিন্তু এই চার্জটা। এই টাকাটা আবার অনেকাংশেই ‘এক্সহিবিটর’-এর উপরে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। এক্ষেত্রে হল মালিকদেরও একটু সুরাহা হল”।
অবশ্য টিকিটের দাম কমানো হলেই যে হুড়মুড়িয়ে দর্শক আসবে না তাও পরিষ্কার করে জানিয়েছেন অঞ্জন। তাঁর কথায়, “একটা দিক থেকে হয়ত ভাবছি ২০০ টাকার টিকিট বাংলা ছবির ক্ষেত্রে ১০০ টাকা হলে সিনেমাহলে লোক বাড়বে। কিন্তু লোক বাড়াতে হলে যে কনটেন্ট বানানো দরকার আমরা সেই কনটেন্ট বানাতে পারছি কি?”
তবে একটা বিষয় নিয়ে খুশি নন শতদীপ। এখনও তিনি আঙুল তুলছেন মাস্টারিং চার্জ নিয়ে। তাঁর কথায়, “কিউব আর ইউএফও কিন্তু প্রযোজকের থেকে মাস্টারিং চার্জ নেয় এবং সেটাও কিন্তু প্রায় ৭৫ হাজার টাকার মত। আমি কিন্তু প্রযোজকের থেকে মাস্টারিং চার্জ নিই না। এমনকি নতুন রেটচার্টে দ্বিতীয় সপ্তাহে যে শো প্রতি ৩০০ টাকা করা হয়েছে তা বহু আগে থেকেই আমরা ২০০ টাকা করে দিয়েছি। তাই খুব হিসেব করে দেখলে বলব, যতই ওরা বলুক যে কমিয়ে দিচ্ছে আসলে কিছুই কমছেনা। কারণ মাস্টারিং চার্জ সহ ধরলে ঘুরে ফিরে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে যায়”। শতদীপের হাতে এই মুহূর্তে ২৭টি স্ক্রিন আছে এবং ভবিষ্যতে আরো কিছু স্ক্রিন বাড়ানোর কথাও তিনি ভাবছেন।

মাস্টারিং প্রসঙ্গে ইম্পা সভাপতির বক্তব্য, “এতদিন ধরে আমরা লড়াই করেছি প্রজেকশনের সর্বভারতীয় রেটের জন্য, মাস্টারিং-এর চার্জ নিয়ে কিন্তু নয়। তা ছাড়াও মাস্টারিং-এর চার্জ তো আগেই কমানো হয়েছে। নন-ডিসিআই (Non-Digital Cinema Initiative) ক্ষেত্রে চার্জ ৪০ হাজার টাকা করা হয়েছে”।
প্রজেকশন চার্জ কমানোর পদক্ষেপ বন্ধ হয়ে যাওয়া সিঙ্গল স্ক্রিন নতুন করে খোলার আলো দেখাবে? এই প্রসঙ্গে পিয়ার বক্তব্য, “অনেক গুলোই খুলবে। তার কারণ হচ্ছে সিঙ্গেল স্ক্রিন অনেকগুলো খুলবে। কারণ, সেকেন্ড বা থার্ড চেন যেগুলো রিলিজ হচ্ছিল সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তাই অনেক হলও বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। এবার ফার্স্ট রিলিজেই প্রযোজকরা অনেক গুলো হল নিয়ে রিলিজ করাবে ফলে সিঙ্গল স্ক্রিন খোলার সম্ভাবনা বেড়ে গেল”।